মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল লাইসেন্সহীন

১১ হাজার ৯৪০ হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমোদন নেই

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতাল লাইসেন্সহীন

অনুমোদনহীন মাইন্ড এইড হাসপাতাল করা হয়েছে সিলগালা

লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চলছে চিকিৎসা সেবা। দেশে বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৭ হাজার ২৪৪টি। এর মধ্যে ১১ হাজার ৯৪০টির অনুমোদন নেই। সিভিল সার্জনদের কাছে সারা দেশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা চেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

ঢাকার আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর জানা যায়, ওই হাসপাতালের সেবা দেওয়ার অনুমোদনই নেই। ২ হাজার ৯১৬টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে কোনো আবেদনই করেনি। ৯ হাজার ২৪টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে কোনো কোনোটি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করলেও এখনো অনুমোদন পায়নি। আবার অনেকগুলোর লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেই অর্থে সেগুলোও অবৈধ। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক কাজ করতে পারবে না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সিভিল সার্জনসহ সবাইকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব জেলায় তারা সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন করবে। যাদের লাইসেন্স নাই, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, তাদের সময় দেওয়া হবে নবায়ন করার। যেখানে যন্ত্রপাতি নেই সেখানেও সময় দিয়ে যন্ত্রপাতি বসানোর জন্য সময় দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে যন্ত্রপাতি বসাতে না পারলে হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হবে। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেওয়া হবে না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, একজন সহকারী পরিচালক ও দুজন মেডিকেল অফিসারের তত্ত্বাবধানে চলে সারা দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৭ হাজার ২৪৪টি। দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২-এর অধীনে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরিচালিত হয়। অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ঢাকার রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসার নামে প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার পর জানা গেছিল  অনুমোদন ছাড়াই চলছিল ওই হাসপাতাল। মাইন্ড এইড হাসপাতালে বরিশাল মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর জানা যায়, ওই হাসপাতালও সেবা দেওয়ার অনুমোদন পায়নি। ২০১৮ সাল থেকে বৈধ লাইসেন্স না থাকলেও, তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের। দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকের নেই পরিবেশ ছাড়পত্র কিংবা সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র। ২০১৮ সাল থেকে লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন করার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে আবেদনপত্র জমা দিতে হয়। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবেন। সবকিছু সন্তোষজনক হলে লাইসেন্স অনুমোদন ও মেয়াদবৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু মাত্র তিনজন কর্মকর্তার পক্ষে এ সার্বিক কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে ধীরগতি। একইভাবে জেলা সদরের সার্বিক তত্ত্বাবধানও চলছিল ঢিমেতালে। ২০১৪ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি জানা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য অধিদফতর হাসপাতালটির সঙ্গে চুক্তি করার বিষয়টি জনসম্মুখে আসে। এরপর থেকেই বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। গত ৭ জুলাই র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা শাখায় অভিযান চালায় এবং করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ উদ্ধার করে। এরপর গুলশানের শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। বেরিয়ে আসে ১১ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ সার্জিকাল সামগ্রী ও নিষিদ্ধ ওষুধ। এ ছাড়া পাওয়া গেছে অনুমোদনহীন কিট ও ভুয়া করোনা রিপোর্টের সনদ। গত ১০ নভেম্বর সারা দেশে অনুমোদিত এবং অনুমোদনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠাতে বিভাগীয় পরিচালকদের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। বিভাগীয় কার্যালয়গুলোর পাঠানো তথ্য নিয়ে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অনুমোদনহীন যেসব চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে ৩ হাজার ৫৩৫টি ঢাকা বিভাগে, ২ হাজার ২৩২টি চট্টগ্রাম বিভাগে, ১ হাজার ৫২৩টি খুলনা বিভাগে, ১ হাজার ৪৩৮টি রাজশাহী বিভাগে, ১ হাজার ৯৯টি রংপুর বিভাগে, ৯৬৩টি ময়মনসিংহ বিভাগে, ৬০৩টি বরিশাল বিভাগে এবং ৫৪৬টি সিলেট বিভাগে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘তালিকা ধরে এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকে অভিযান চালিয়ে সেগুলো বন্ধ করা হবে। গত ১০ দিন আগে সমস্ত জেলার সিভিল সার্জনদের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বৈঠক হয়েছে। তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালের তালিকা পাঠাতে। এর মধ্যে বেশিরভাগ জায়গা থেকে আমরা তথ্য পেয়ে গেছি। কিছু তথ্য এখনো পাইনি।’

সর্বশেষ খবর