শিরোনাম
বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

রিজার্ভের অর্থের উত্তম ব্যবহার যেভাবে করা যায়

মামুন রশীদ

রিজার্ভের অর্থের উত্তম ব্যবহার যেভাবে করা যায়

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সম্প্রতি ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। মূলত অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক উচ্চপ্রবাহ আর আমদানি ব্যয়ের চাপ কম থাকায় এমন হয়েছে। রপ্তানি পুনরুজ্জীবন এবং তুলনামূলকভাবে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত অর্থছাড় প্রবাহের ইতিবাচক গতিও এখানে ভূমিকা রাখছে। এ রিজার্ভের যাকে তুলনামূলকভাবে উচ্চ বলে গণ্য করা হচ্ছে সর্বোত্তম ব্যবহার প্রশ্নে বিভিন্ন রকমের পর্যালোচনা বা কথাবার্তাও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন এ রিজার্ভের একটা অংশ সরকার জাতীয় অগ্রাধিকারের অবকাঠামো প্রকল্পগুলির অর্থায়নে ব্যবহারের কথা ভাবতে পারে। উন্নয়ন সহযোগীরা একবার ভেবেছিল রপ্তানি বাড়াতে বাংলাদেশের এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সি (ইসিএ) বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক স্থাপন করা উচিত। বাংলাদেশ যেহেতু মূলধনি যন্ত্রপাতি রপ্তানি করে না তাই এ চিন্তাটা শেষতক তলিয়ে গেছে। এটা অবশ্য এশীয় শতাব্দী। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্থায়নের বিষয়ে আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকারগুলো গতিশীল পরিবর্তনের ধারার মধ্য দিয়ে চলছে। অনেকে আবার উদ্বৃত্ত রিজার্ভ দিয়ে ‘সার্বভৌম সম্পদ তহবিল’ সভরেন ওয়েলথ ফান্ড (এসডব্লিউএফ) চালু করার কথাও বলে চলেছেন।

এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, সরকারই দেশের সব আর্থিক সম্পদের রক্ষক। ফলত সম্পদ ব্যবস্থাপনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অন্যতম। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এসব সম্পদ সবচেয়ে ফলপ্রসূভাবে লাভজনক উপায়ে পরিচালন করতে পারি যাতে অর্থনীতি এবং নাগরিকরা উপকৃত হয়। এও মনে রাখা চাই, এ সম্পদ উন্নয়ন তহবিল হিসেবে নয়, অবশ্যই লাভজনক তহবিলরূপে পরিচালন করতে হবে।

সভরেন ওয়েলথ ফান্ড হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় বিনিয়োগ তহবিল, যার মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন আর্থিক সম্পদে যেমন স্টক, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, মূল্যবান ধাতু, ডেরিভেটিভস ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে। সভরেন ওয়েলথ ফান্ডের জন্য তহবিল আসে সাধারণত বিভিন্ন উৎস থেকে যেমন রাজস্ব উদ্বৃত্ত, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার কার্যক্রম এবং সরকারি অর্থ পরিশোধ স্থানান্তর থেকে। বৃহত্তর, এসডব্লিউএফ প্রাকৃতিক সংস্থান সম্পর্কিত এবং সুসংহত শক্তি হিসেবে কাজ করে। অবস্থা ও পরিস্থিতি ভেদে সভরেন ওয়েলথ ফান্ডের উদ্দেশ্য একেক দেশে একেক রকম হয়। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবের মতো তেল রপ্তানিকারী দেশে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড তেলের দর কমে গেলে বা পণ্য থেকে রাজস্বে বিরাট ঘাটতিতে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড বাফার হিসেবে কাজ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কোনো দেশের তহবিল উদ্বৃত্ত হয়ে পড়লে সেটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফেলে না রেখে কিংবা ফের অর্থনীতিতে পুনঃসঞ্চালন না করে দেশটি ওই তহবিলকে বিনিয়োগে খাটানোর জন্য সভরেন ওয়েলথ ফান্ড ব্যবহার করে। খুব সাধারণ ভাষায়, একটি এসডব্লিউএফ বিনিয়োগকারী হিসেবে সরকারের কিছু অর্থ উপার্জনের বাড়তি উপায় হতে পারে।

সভরেন ওয়েলথ ফান্ড থাকার কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন এটা হতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিনিয়োগের একটা ভালো মাধ্যম; দেশের নিয়মিত আয়/মুনাফার বাড়তি উৎস। অতিরিক্ত তহবিলকে অলস পড়ে থাকতে না দিয়ে তার সার্থক ব্যবহারের চমৎকার উপায় হলো এসডব্লিউএফ। এটা দেশের অর্থনীতির সুস্থিতি গড়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। এসডব্লিউএফ যদি বহুবিধ খাতে বিনিয়োগ করা হয়, এতে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য সম্পদ সুগ্রন্থিত করে তোলা যায়।

বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতির দেশে এসডব্লিউএফ দিয়ে ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন এজেন্ডা (যেমন সভরেন ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) পরিচালন করতে পারে। আমাদের অবকাঠামোগত মেগা প্রকল্পগুলোর এবং কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর সূচনা ঘটানোর কাজেও এ তহবিল ব্যবহার করা যেতে পারে। আবুধাবির মুবাদালা ইনভেস্ট কোম্পানি সংযুক্ত আরব আমিরাতের বহুমুখী শিল্প বিকাশের সহায়ক হয়েছে। সেখানে উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ তৈরি ও হেলথকেয়ার সরঞ্জাম উৎপাদনের মতো নতুন নতুন শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ইসকান্দার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে সে দেশের খাজানা ন্যাশনাল বেরহাদ; এ ইসকান্দার মালয়েশিয়ার শেনজেন নামে অভিহিত।

ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য সভরেন ওয়েলথ ফান্ড ব্যাপকভিত্তিক নীতিকাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। মুদ্রানীতির অমর্যাদা যাতে না ঘটে, সেজন্য এ তহবিলকে অবশ্যই হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যাবলির সঙ্গে সমন্বিত। চিলিতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিক্রমায় সরকারি ব্যয় সুষ্ঠুতর করতে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড করা হয়েছে। অনুরূপ বাংলাদেশেও বৈরী সময়ে আঘাতরোধক (শক অ্যাবজরভার) হিসেবে কাজ করতে পারে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড, যার দ্বারা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রশমিত করা যাবে অচিন্তনীয় ও নিয়ন্ত্রণ-অযোগ্য নেতিবাচক ঘটনাবলির অভিঘাত। এ ছাড়া বাংলাদেশি রিজার্ভ অলস বসে থাকার পরিণামে টাকার মূল্যমান বাড়িয়ে তুলবে, এর ফলে আমাদের রপ্তানি হয়ে উঠবে ব্যয়বহুল। এ রিজার্ভ বিদেশে বিনিয়োগ করে প্রয়োজনীয় নগদ আহরণ সম্ভব।

বাণিজ্যের দুর্বল শর্ত বলবৎ থাকাকালে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড একটা কুশন হিসেবেও কাজ করতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অপব্যবহারের সুযোগ একটুও নেই- এ রকম লৌহদৃঢ় শাসনের শিকড়বদ্ধ হতে হবে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড। তাই তহবিলকে দুর্নীতি কবলগ্রস্ত হওয়ার বাতাবরণে রাখা যাবে না। দেশি প্রকল্পের অর্থায়নে ব্যবহারের সময় সভরেন ওয়েলথ ফান্ড সহজেই হয়ে উঠতে পারে দুর্নীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা কিংবা আত্মসাতের মজার জায়গা। এসডব্লিউএফের বেলায় গতানুগতিক বাজেটারি প্রটেকশন ও পার্লামেন্টারি নজরদারি যেহেতু থাকবে না, সেহেতু নিম্নমানের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া ডিঙানো সম্ভব। বাংলাদেশের ব্যাংক ঋণ, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের অপব্যবহার ও দুর্নীতির ব্যাপারটি (যা উচ্চহারে ঋণখেলাপি যন্ত্রণা তৈরি করেছে), যেভাবে অত্যন্ত নেতিবাচক অবস্থা দেখাচ্ছে তাতে বিষয়টি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যাসংকুল হতে পারে। কাজেই সভরেন ওয়েলথ ফান্ড ব্যবহারের সময় বিশেষ করে দেশজ অবকাঠামো প্রকল্পে এটা ব্যবহারের সময় কর্তৃপক্ষকে খুবই উচ্চ পর্যায়ের সাবধানতা অবলম্বন করা চাই। দেখতে হবে তহবিল ব্যবস্থাপনা ও বিতরণ যেন সে রকম ফাঁদে না পড়ে যে ফাঁদ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাতকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মালয়েশিয়ার ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারির কাহিনি স্মরণ করা যায়। উন্নয়ন কার্যক্রম গতিময় করাব লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ তহবিল হিসেবে ওয়ানএমডিবির যাত্রা হয় ২০০৯ সালে। অভিযোগ উঠেছে, মালয়েশিয়ার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক এ তহবিলের ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার তছরুপ করেছেন। এ এক নজিরবিহীন দুর্নীতির কারবার যা আর্থিক বিশ্বকে ঝাঁকুনি দেয়। এটা খুবই সম্ভব যে, বাংলাদেশের প্রভাবশালী ও শক্তিমান ব্যক্তিরা এবং সিন্ডিকেটও এসডব্লিউএফ নিয়ে ওই একই রকম লালসার ধারক। দুর্নীতির মতলবে উদ্বৃত্ত বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর ইতিমধ্যে ‘লোভাতুর নজর’ রাখা শুরু হয়ে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

এ তহবিলের মালিক সরকার। ফান্ডের লক্ষ্যাবলি স্থির করা, কার্যকর জবাবদিহির রূপরেখা তৈরি এবং যথাযথ করপোরেট গর্ভন্যান্স তাকে অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। তহবিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের হতে হবে বিনিয়োগ কৌশলবিদ্যায় প্রাজ্ঞ, পেশাদার। তাদের দিতে হবে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা।

সভরেন ওয়েলথ ফান্ড থেকে নেওয়া তহবিলের সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য স্বয়ংশাসিত নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে। এ কর্তৃপক্ষের থাকবে ব্যাপক ক্ষমতা যাতে তহবিল আত্মসাৎকারী বা তহবিল নিয়ে জালিয়াতির দায়ে অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে। বিতর্ক হতে পারে, যে দেশ স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল হতে চলেছে, যে দেশটি অগ্রাধিকারভিত্তিক সব সুবিধা ভোগ করতে আগ্রহী তার পক্ষে কি সভরেন ওয়েলথ ফান্ড চালু করা উচিত?

জবাবে বলা যায়, এটা গতানুগতিক সভরেন ওয়েলথ ফান্ড হবে না। এর একটা অংশ বড় বড় অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন খাতে মূলধনি বিনিয়োগ হিসেবে, আরেকটি অংশ এফডিআই সহায়ক মূলধন আর এশীয় দেশগুলোয় বিনিয়োগরূপে ব্যবহার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে আমরা সভরেন বন্ড ছাড়ার কথাও ভাবতে পারি। যে বন্ড ছাড়ার বিষয়টি দীর্ঘকালের জন্য হিমাগারে রাখা হয়েছে।

এসডব্লিউএফের ফলপ্রসূ ব্যবহার প্রসঙ্গে বলতে হয়, বহুবিধ খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে এ তহবিলের সার্থকতার মূল। এ জন্য তহবিল ব্যবস্থাপকদের এমনভাবে কৌশল নির্ণয় করা চাই, যাতে বহুবিধ খাতের বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো দেশও সমান উপকৃত হতে পারে। এটা অর্জনের জন্য যেসব দেশ সভরেন ওয়েলথ ফান্ডের প্রয়োগ ঘটিয়ে সফল হয়েছে তাদের কর্মকৌশল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে যারা বাংলাদেশের মতো এক স্তরে রয়েছে এবং সভরেন ওয়েলথ ফান্ড করে সফল হচ্ছে তাদের কাছ থেকে শিখতে হবে। তাদের থেকে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করতে হবে। নিতে হবে সহায়তা।

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর