বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ভোট ছাড়াই ব্যবসায়ী নেতা

সংগঠনগুলোও আর নির্বাচনে আগ্রহী নয়, নেই কোনো প্রতিযোগিতাও, এফবিসিসিআই বিজিএমইএ ডিসিসিআই এমসিসিআই বিকেএমইএ বিটিএমএ বিএবিসহ ৩ শতাধিক সংগঠনে একই হাল

মাহমুদ আজহার ও রুহুল আমিন রাসেল

ভোট ছাড়াই ব্যবসায়ী নেতা

দেশে ভোট ছাড়াই এখন নেতা হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বছরের পর বছর ধরে নির্বাচন নেই অধিকাংশ বাণিজ্য সংগঠনে। ফলে ভোটবঞ্চিত সাধারণ ব্যবসায়ীরা। সংগঠনগুলোও আর ভোট করতে আগ্রহী নয়। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো প্রতিযোগিতা। ভোটবিহীন নেতা মনোনীত হচ্ছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে। প্রাচীন বাণিজ্য সংগঠন ডিসিসিআই ও এমসিসিআইতেও অনির্বাচিত প্রতিনিধি। গার্মেন্টস মালিকদের প্রভাবশালী দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতা হন বিনা ভোটে। বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বিটিএমএতেও ভোট নেই। একই অবস্থা ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির। দেখা গেছে, ৩ শতাধিক বাণিজ্য সংগঠনে এখন আর ভোট হয় না।

জানা যায়, জেলা চেম্বার, উইমেন চেম্বার, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জয়েন্ট চেম্বার মিলিয়ে শতাধিক ও পণ্যের খাতভিত্তিক ৪ শতাধিক অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। সব মিলিয়ে সারা দেশে ৫ শতাধিক বাণিজ্য সংগঠন। জেলা চেম্বার ও কয়েকটি অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী ভোট হলেও অধিকাংশ বাণিজ্য সংগঠনে ভোট হয় না। এর মধ্যে ৩ শতাধিক বাণিজ্য সংগঠন রয়েছে ভুঁইফোড় ব্যবসায়ীদের পকেটে। ‘কাগজে কলমে’ সাধারণ সভা ও ভোট দেখিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়। কার্যক্রম না থাকা এসব বাণিজ্য সংগঠন ব্যক্তিস্বার্থে কুক্ষিগত রাখা হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সারা দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচনে সাধারণ ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব বাণিজ্যিক সংগঠনকে কিছু শর্তে নিবন্ধন দেওয়া হয়। সেখানে যদি ভোট করার কথা থাকে আর সেটা না করা হলে সেখানে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যে কর্তৃপক্ষের কাছে তারা নিবন্ধিত তাদের দায়িত্ব হবে এসব সংগঠনকে পর্যবেক্ষণ করা। যখনই নির্বাচন না হবে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়া। বেসরকারি সংগঠন হলেও তাদের আইনগত অস্তিত্ব আছে। যথাযথভাবে নির্বাচন হয়েছে কি না তা তদারকি করতে হবে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে। ভোট না হলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এতেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমি মনে করি।’

লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘একটি দেশে শিল্প ব্যবসা চেম্বার খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। দেশের অর্থনীতির পরিচালক তারা। ওইসব প্রতিষ্ঠানের নেতা নির্বাচনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বর্তমানে গোপন ব্যালটের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যস্থতায় নেতা মনোনীত হচ্ছেন, নির্বাচিত নন। এ প্রবণতা জাতীয় রাজনীতির চরিত্রেরই প্রতিফলন। ভোটারবিহীন নির্বাচনের যে সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে উঠেছে তারই প্রতিফলন ঘটছে প্রতিটি পেশাজীবী সংগঠনে। এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রগতির সহায়ক নয়।’

জানা যায়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মিনি পার্লামেন্ট খ্যাত বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআইর সর্বশেষ ২০১৯-২০২১ মেয়াদের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে সব পরিচালক প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়। পদ ও প্রার্থীর সংখ্যা সমান হওয়ায় বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা অনুযায়ী পরিচালক পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এফবিসিসিআইর সাধারণ পর্ষদের সদস্যদের ভোটহীন এ নির্বাচনকে বিরল দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও বিগত বিএনপি সরকার আমলে এফবিসিসিআইর নির্বাচনে সভাপতি, প্রথম সহসভাপতি ও সহসভাপতি পদে ভোটাধিকার হারান সংগঠনটির সাধারণ পরিষদের সদস্যরা। এরপর দেশে বারবার ভোটাধিকার খর্ব করা হচ্ছে এফবিসিসিআইতে। তখন যুক্ত করা হয় মনোনীত পরিচালক প্রথা। কোন কোন বাণিজ্য সংগঠন থেকে মনোনীত পরিচালক হবেন, তা ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এর পর থেকে এফবিসিসিআইর প্রতিটি নির্বাচনে সাধারণ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত পরিচালক ও মনোনীত পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হন সভাপতি ও দুই সহসভাপতি। জানা গেছে, এবার ভোট হচ্ছে না প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএতে। সংগঠনটির সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের কর্ণধার ফারুক হাসান পরবর্তী সভাপতি হচ্ছেন- এ কথা মালিকদের মুখে মুখে। আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহে এ নির্বাচন ঘিরে ফারুক হাসানের পক্ষে সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীরা খুবই তৎপর। বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হকের নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী এপ্রিলে। তিনি সভাপতি হয়েছিলেন মালিকদের দুই পক্ষ সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের সমঝোতায়। এর আগে সংগঠনটির সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানও সমঝোতা করেই সভাপতি হন। এতে ভোটবঞ্চিত হন গার্মেন্টস মালিকরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের এখন সব ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। প্রায় শতভাগ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই এখন সরকার সমর্থকদের দখলে। তাই এসব প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রয়োজনবোধ করছে না। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের শূন্যতা থাকলে এমনটাই হয়। কার্যত বাংলাদেশই রাষ্ট্রীয়ভাবে এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।’

সংগঠনটির আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রয়োগ আগে এক রকম হতো, এখন আরেক রকম হচ্ছে। বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় মাঝেমধ্যে পরিবর্তন হওয়াই ভালো। আসলে নেতৃত্বে যোগ্য লোক এলে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।’ এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘সারা দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় সরাসরি ভোট না হওয়ায় সাধারণ ব্যবসায়ীদের সম্মান থাকে না। নেতৃত্বের জবাবদিহিও থাকে না। সাধারণ ব্যবসায়ীরা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন। নেতৃত্বের যোগ্যতা নির্বাচনে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোয় সরাসরি ভোট হওয়া জরুরি।’ এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ‘আমাদের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোয় ভোট না হলেও অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি বাণিজ্য সংগঠনগুলোয় নির্বাচন হওয়া উচিত। যেমন ভারতে সফল ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করে দেশটির শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনের নেতা বানানো হয়। কারণ সফল ও ভালো ব্যবসায়ীরা নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বে আসতে চান না। তাদের সঠিক নেতৃত্ব হিসেবে পেতেই আমন্ত্রণ জানিয়ে আনতে হবে।’ বাংলাদেশেও তেমনটা হওয়া উচিত বলে মনে করেন ভারত- বাংলাদেশ চেম্বারের এই সভাপতি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর