বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আলোচনা বন্ধ রোহিঙ্গা ফেরতের

চীন ভারত জাপানকে মধ্যস্থতায় নেওয়ার চেষ্টায় বাংলাদেশ

জুলকার নাইন

আলোচনা বন্ধ রোহিঙ্গা ফেরতের

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তিন বছর পর তাদের ফিরে যাওয়ার আলোচনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বছর দেড়েক হলো মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা বন্ধ। চীনের মধ্যস্থতার কথা শোনা গেলেও কার্যকারিতা নেই। আর শুধু বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়া কোনো তৎপরতা নেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। পরিস্থিতি অনুধাবন করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে দিনক্ষণ চাওয়ার চিন্তা করছে সরকার।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। গত বছর দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনের পক্ষে সব দেশ নিজেদের অবস্থান জানান দিলেও এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।  রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) শেষ বৈঠকটি হয়েছিল ২০১৯ সালের মে মাসে। এ বছরের শুরুতে ঢাকায় জেডব্লিউজির বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে সেই বৈঠক না হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কার্যত ১৬ মাস ধরে কোনো আলোচনাই হচ্ছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করেছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকেই তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় চীন নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে। আর ২০১৮ সাল থেকে দেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় সরাসরি যুক্ত রয়েছে। অবশ্য চীনের উদ্যোগে এর আগে কয়েক দফার বৈঠক হলেও কার্যত প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার কিছুই করেনি।

তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, করোনা মহামারীর কারণে গত ২০ জানুয়ারির পর এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। ৮ নভেম্বর নির্বাচন শেষ হয়েছে। অং সান সু চির জোট নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হয়েছে। এখন তারা সরকার গঠনের প্রস্তুতিতে রয়েছে। যখন সব দেশ মিয়ানমারের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেবে তখন বাংলাদেশও তা করবে। সরকার গঠনের পর প্রত্যাবাসন নিয়ে ঢাকা নতুন করে আলোচনা শুরু করবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে চীনসহ প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে নতুন করে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। প্রত্যাবাসন বিষয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার ত্রিদেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠক বেইজিংয়ে অনুষ্ঠানের প্রস্তাব রয়েছে। প্রস্তাবিত বৈঠকটির দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। অবশ্য এমন বৈঠক আগেও তিন দফা হয়েছে। বাংলাদেশ সেই বৈঠকে অংশগ্রহণের অপেক্ষায় রয়েছে। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়ে দিনক্ষণ চাওয়া হবে মিয়ানমারের কাছে। ড. মোমেন বলেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ কেবল চীনের দিকে চেয়ে নেই। জাপান, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বাংলাদেশের অনেক বন্ধু সংকটটির নিরসনে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে চাপ বাড়িয়েছে। বৈশ্বিক চাপে মিয়ানমার বারবার প্রত্যাবাসনে রাজি থাকলেও দুর্ভাগ্যজনক তারা এখনো তাদের বাস্তুচ্যুত একজন নাগরিককেও ফিরিয়ে নেয়নি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশ আরও কয়েকটি দেশকে বিশেষ করে ভারত এবং জাপানকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। কারণ চীনের বাইরে মিয়ানমারে বিনিয়োগের কারণে প্রভাব আছে জাপান ও ভারতের। মিয়ানমারে জাপানের বিনিয়োগ প্রচুর। গত কয়েক বছরে অনেক গুণ বেড়েছে। সুতরাং মিয়ানমার জাপানের কথা শুনবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাপানের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জাপানের পক্ষ থেকেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গেও মিয়ানমারের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। তাই ভারতের সঙ্গে সব বৈঠকেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা করা হয়। এখন মিয়ানমারে নির্বাচন-পরবর্তী নতুন সরকার হলে এই দেশগুলোকে নিয়ে চাপ তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে জার্মানির ভূমিকাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ জার্মানি বিনিয়োগ স্থগিত করেছে। বলেছে যে, প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত এগুলো বন্ধ থাকবে। অন্য দেশগুলো জার্মানির মতো ভূমিকা নিলে সহজেই প্রত্যাবাসন সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বহুমাত্রিক চাপ বাড়াতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারতও মিয়ানমারকে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ভারত ও জাপান যদি মিয়ানমারের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়, তখন চীনের এককভাবে মিয়ানমারের পক্ষে থাকা কষ্টকর হবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর