রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কী হবে কর্মহারাদের

দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে, পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে গিয়ে অনেকেই আর ফিরতে পারছে না বিদেশফেরত অধিকাংশই কর্মস্থলে ফিরতে পারছে না, আবার দেশেও কাজ নেই

মানিক মুনতাসির

কভিড-১৯ মহামারীজনিত অচলাবস্থার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়েছে। এখনো অনেকে বেকার হচ্ছে। গত ১০ মাসে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে দারিদ্র্যের কশাঘাতও। চলতি বছর মার্চে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর চাকরি হারিয়েছে এবং আয় কমেছে অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষের। আর দারিদ্র্যের হার উঠেছে ৪০ শতাংশে। ফলে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে চাকরিহারাদের। শহরে টিকতে না পেরে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। তার বেশির ভাগই আর শহরে ফিরতে পারছে না। আবার বিদেশফেরত কর্মীর অধিকাংশই কর্মস্থলে ফিরতে পারছে না। শুধু তাই নয়, তারা দেশেও কাজ পাচ্ছে না। তাই জীবন বাঁচাতে রুটি-রুজির জন্য লড়ে যাচ্ছে। এর অনেকেই এখন ঢাকায় ক্ষুদ্র ব্যবসায় লিপ্ত। এমনকি কেউ কেউ হ্যান্ড স্যানিটাইজার, শীতের পোশাক, সবজি বিক্রি করে জীবন ধারণের চেষ্টা করছে। নতুন কর্মসংস্থান দূরের কথা পুরনো বেকাররাই কাজ পাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশ থেকে ফিরে আসা প্রায় ১২ লাখ কর্মী। ফলে সামনের দিনে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত হবে করোনাকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্টভাবে কর্মসৃজনমূলক কিছু উদ্যোগ নেওয়া। এ ছাড়া কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মতো আত্মকর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, সরকারের নেওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন খুবই জরুরি। বিশেষ করে ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। যদিও প্রণোদনা প্যাকেজে এসএমই খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো এ খাতে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। ফলে প্রণোদনা প্যাকেজের সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

কেস স্টাডি-১ : শামিমুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। থাকতেন সৌদি আরবে। প্রায় ১০ বছর সেখানে নির্মাণ খাতে কাজ করেছেন। মার্চে দেশে ফিরে এসেছেন। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর। স্ত্রী-সন্তানরা আগে থেকেই থাকতেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে। বড় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেষ হয়নি। কভিড-১৯-এর ফলে ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। তিনি কয়েক মাস ধরে কর্মস্থলে ফেরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে কোম্পানিতে কাজ করতেন সে কোম্পানি তাকে কাজে না ফেরার বার্তা দিয়েছে। দেশেই কিছু করবেন বলে ঠিক করেন। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যেও মন্দা। পুঁজিরও সংকট। ফলে বাবা-ছেলে মিলে দুটি ভ্যানে সবজি আর শীতের কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছেন। এ থেকে যা মুনাফা হয় তা দিয়ে কোনোরকমে টিকে থাকার যুদ্ধ করছেন শামিমুল।

কেস স্টাডি-২ : প্রীতম। ¯œাতকোত্তর শেষ করেন ২০১৮ সালে। এরপর কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে একাধিকবার পরীক্ষা দেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে আর টেকেননি। চাকরিও হয়নি। এভাবেই কেটে গেছে প্রায় দেড় বছর। চলতি বছরের প্রথম থেকে চলছে করোনাকাল। বন্ধ হয়ে যায় প্রায় সব ধরনের চাকরির নিয়োগ। ছয় মাসের বেশি সময় পর সীমিত পরিসরে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেও প্রীতম এখনো চাকরি পাননি। সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া বাবার ঘাড়ের বোঝা হিসেবে দিন কাটছে তার।

কেস স্টাডি-৩ : রায়হান টিপু। রাজধানীর একটি আইটি ফার্মে কাজ করেন তিন বছরের মতো। বিয়ে করেছেন এক বছর আগে। এরই মধ্যে করোনার কারণে বেতন-ভাতাসহ অফিসের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমে গেছে। ফলে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে নিয়ে না যেতে পারছেন গ্রামে না থাকতে পারছেন রাজধানীতে। কোনোরকমে জীবনযুদ্ধে টিকে আছেন। অন্যত্র চাকরি খুঁজছেন। কিন্তু করোনা অচলাবস্থার কারণে নতুন কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সূত্র জানান, করোনার ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি খাত। নতুন কর্মী নিয়োগ প্রায় বন্ধ। সরকারি খাতেও বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। লোকসান ঠেকাতে আর প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সীমিত পরিসরে কর্মী নিয়োগ চালু রেখেছে ব্যাংক, বীমাসহ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্র্যাকের হিসাবে কভিড-১৯-এর কারণে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৩২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। আর আয় কমেছে ৮৪ শতাংশ মানুষের। এমনকি যারা কাজ হারিয়েছে বা দারিদ্র্যসামীর নিচে নেমে গেছে তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। জানা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে শুরু হওয়া মহামারী করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে এ বছরের শেষে এসেও। বিশেষ করে দেশের বেসরকারি খাতের অবস্থা খুবই নাজুক। নতুন করে তো কোনো কর্মী নিয়োগ হচ্ছেই না, বরং পুরনোদের ধরে রাখতে উদ্যোক্তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি খাতে চলছে ব্যয় সংকোচন নীতির বাস্তবায়ন। ফলে সরকারি প্রতিষ্ঠানেও নতুন করে কর্মী নিয়োগ আগের মতো হচ্ছে না। আবার বিদেশে যাওয়ার পথও প্রায় বন্ধ। চলতি বছরের গত ১০ মাসে ৩ লাখ কর্মীও বিদেশে যেতে পারেনি কাজের উদ্দেশ্যে। অথচ আগের বছরের একই সময়ে অন্তত ১০ লাখ কর্মী দেশের বাইরে গিয়েছিল। উপরন্তু করোনাভাইরাস আতঙ্কে গত কয়েক মাসে অন্তত ১২ লাখ বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছে যাদের মধ্য থেকে মাত্র ২ লাখ ফিরে যেতে পেরেছে আগের কর্মস্থলে। দেশের অভ্যন্তরে চাকরি, শ্রমবাজার, কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের পুরো ব্যবস্থাই প্রায় ধসে পড়েছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে উদ্যোক্তারা রীতিমতো যুদ্ধ করছেন। আয় কমে যাওয়ায় সরকারও ব্যয় কমিয়ে আনছে। ফলে কাজের বাজার নিয়ে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, জুলাই শেষে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২০ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে এটা ছিল ২৪ শতাংশ। সেখানে চার বছরে দারিদ্র কমেছিল ৪ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর-জুলাই সাত মাসে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে দারিদ্র্যের হার আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্র্যাক ও পিপিআরসি। অন্যদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর তথ্যমতে, দারিদ্র্যের হার এখন ৩৫ শতাংশ। যা ডিসেম্বর, ২০১৯-এ ছিল ২০ শতাংশ। সিপিডির জরিপ বলছে, একইভাবে দেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্টে। যা ২০১৬ সালে ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্ট। ফলে করোনা পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর