রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
দূরদর্শী নেতৃত্বে বদলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাত

আর নয় কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র

জিন্নাতুন নূর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে বিদ্যুতের উৎপাদন আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার পর নেওয়া হচ্ছে আরেকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। পরিবেশের কথা চিন্তা করে কয়লাভিত্তিক জ্বালানি প্রকল্প থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করেছে সরকার। জ্বালানি হিসেবে কয়লানির্ভরতা কমাচ্ছে বাংলাদেশ। বিগত কয়েক বছরেও নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়নি এমন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আর বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত আসছে। প্রধানমন্ত্রীর এই দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের বিদ্যুৎ খাতের গুণগত মান আরেক দফায় বদলে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি সারসংক্ষেপ যাচ্ছে। মূলত বেশ কিছু কয়লাভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে অনেক বছর আগে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রকল্পগুলোর ব্যয়ভার বইতে পারব না। চুক্তি অনুযায়ী কেউ যদি সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারে, তাহলে তার চুক্তি বাতিল করা হবে। যেহেতু এগুলো বড় প্রকল্প এজন্য চুক্তি বাতিলের আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদ্যুতের মাস্টারপ্ল্যান পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তখন ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা কেমন হবে আর সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার কতটা যৌক্তিক হবে এগুলো আমলে নেওয়া হচ্ছে। তবে মাতারবাড়ী, পায়রা ও রামপাল প্রকল্পগুলোর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহতও থাকবে।’ তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জ¦ালানি পরিকল্পনায় সাশ্রয়ী জ্বালানির কারণে কয়লাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সে সময় গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে অন্য জ্বালানিরও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কয়লা এখন আর সাশ্রয়ী জ্বালানি নয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর টানা কয়েক মেয়াদে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ গ্রহণের ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন দেশ স্বাধীনের পর এখন সবচয়ে বেশি। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯ নভেম্বর দেশে দিনের বেলা বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ১১০ মেগাওয়াট আর বিকালের পর চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৪২২ মেগাওয়াট। দেশের এখনকার মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক এই চাহিদা। এখন দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট।

এখন বিদ্যুতের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক কমে আসায় ব্যয়বহুল জ্বালানি কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার ব্যাপারে আগের সিদ্ধান্ত পুনর্মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এই মূল্যায়নের ওপরই এখন নির্ভর করছে প্রক্রিয়াধীন বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ। যদি এই প্রস্তাব গৃহীত হয় তবে পাঁচটি ছাড়া বাকি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাতিল করা হবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নতুন যে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হচ্ছে সেখানেও কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও যাচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও পেট্রোলিয়ামভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব।

জানা যায়, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে। এজন্য ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনও দেয়। আর এই বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের ৩৫ শতাংশই কয়লা থেকে উৎপাদন করার কথা ভাবা হয়েছিল। অথচ বিগত কয়েক বছরেও প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১৩টির কোনো অগ্রগতি হয়নি।

পরিবেশকর্মীরাও মনে করেন, কয়লার ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশ মারাত্মক জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আর বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে দেয়, তবে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে পারবে। এর পাশাপাশি কয়লার বিকল্প হিসেবে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎশক্তির উৎসগুলোকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কয়লার জন্য যে জমির প্রয়োজন তা পরিমাণে অনেক বেশি। আবার কয়লা পরিবহনও সহজ নয়। এ ছাড়া কয়লার যে পরিবেশগত মূল্য, সেটিও অনেক বেশি। আর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি তো আছেই।

কর্মকর্তারা জানান, কয়লাভিত্তিক ২৩টি প্রকল্পের মধ্যে বড়পুকুরিয়ার ৫২৫ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াটের একটিসহ মোট তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পায়রার প্রথম ইউনিটও এরই মধ্যে উৎপাদনে এসেছে। আর সরকারি, বেসরকারি এবং যৌথ উদ্যোগে আরও সাতটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ এখন চলমান রয়েছে। এর মধ্যে আছে কোল পাওয়ার জেনারেশন বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের ১২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ী আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্লান্টের প্রথম ইউনিট,  চট্টগ্রামের ১২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার এসএস পাওয়ার লি., বরিশালের ৩০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার, ঝাড়খ- ১৬০০ মেগাওয়াট ইন্ডিয়ান আদানি পাওয়ার লি., বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লি. মৈত্রী ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার থারমাল, বিসিপিসিএলের পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট এবং রুলার পাওয়ার  কোম্পানি লিমিটেডের পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ হয়েছে ১৬ থেকে সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ। ফলে বাকি ১৩টি প্রকল্প আর বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্তই আসছে। বর্তমানে দেশে গ্যাস, তেল, পানি, সৌরশক্তি ও কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিরও উৎপাদনে যাওয়ার কথা।  বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার কারণে প্রথম দিকে মাতারবাড়ী ও রামপাল  বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর কাজের গতি কিছুটা কমে গেলেও তা থেমে যায়নি। আশা করছি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শেষে  আমরা এই মেগা প্রকল্পের কাজে যে বাধা এসেছে তা দ্রুত পুষিয়ে নিতে পারব।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর