শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ছোট্ট ফ্ল্যাটে বড় স্বপ্ন

ফরিদুর রেজা সাগর

তিনি অবহেলিত মানুষের সন্ধানে জেলা উপজেলায় ছুটে বেড়ান। তিনি বই পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন আমাদের। তিনি ক্লাসরুমের বাইরেও আমাদের জীবনযাপনের শিক্ষক। তিনি একদা অধ্যাপনা করতেন। তিনি একজন স্বনামধন্য টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের অভিভাবক। আমাদের শিক্ষক। তখন আমরা চ্যানেল আই শুরু করেছি। স্বাভাবিকভাবে আমরা তার বুদ্ধি-পরামর্শ নিয়ে থাকি। তার পরিকল্পনায় শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানও শুরু   করেছি। স্যার সব সময় তার ভালোবাসা আমাদের জন্য উদারভাবে বিতরণ করে থাকেন। আমাদের কোনো প্রস্তাবে তিনি না করেন না। যখন খুশি তিনি চ্যানেল আইতে আসেন। নিজের মতো সময় কাটান। আমরা তার ভালোবাসা ও স্নেহের উত্তাপ টের পাই। আমরা যেকোনো কাজে সাহস পাই। কারণ তিনি আমাদের মাথার ওপর আছেন। একদিন সকালে কোনো এক কাজে স্যারের বাসায় গেছি। এক ভাড়া বাসায় তিনি থাকেন। ছোট্ট পরিসরের পুরানা এক বাসা। ছোট্ট জানালা। চারদিকে বদ্ধ পরিবেশ। ছোট্ট এক খাটে স্যার বসে কাজ করছেন। কী হে সাগর, বসো। স্যারের সঙ্গে কাজের কথা শেষ করে বের হয়ে এলাম। এই মহান শিক্ষক সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে চিন্তা করেন। তাদের মানস গঠনে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় তা নিয়ে সবসময় ভাবেন। তার এই দীনতা দেখে মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। স্যার এত সাধারণ জীবন যাপন করেন? ছোট্ট একটা ঘর। সেখান থেকে স্বপ্ন তার ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। আমরা তার ছাত্র। এত বড় টেলিভিশন ব্যক্তিত্বের এই রকমভাবে জীবন ধারণ করা। খুব গ্লানিবোধ হলো আমাদের। স্যারের আরেক প্রিয় ছাত্র ইফতেখারুল ইসলামের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বললাম। কিছু করা যায় কিনা ভাবতে লাগলাম। শেলটেকের পরিচালক তৌফিক এম. সেরাজও স্যারের প্রিয় ছাত্রদের একজন। তার সঙ্গে আলাপ করলাম। ধানমন্ডি এলাকায় স্যারের জন্য একটা ফ্ল্যাট পাওয়া যায় কি না। বসবাসের জন্য আরেকটু প্রশস্ত স্থান দরকার। কিন্তু তৌফিক এম. সেরাজ খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, স্যারের জন্য একটা ফ্ল্যাটের। ব্যবস্থা করতেই পারি। কিন্তু স্যার গ্রহণ করবেন না। ভাবলাম, আমাদের প্রস্তাবও স্যার মানবেন না। তাহলে কি করা যায়। স্যারের দুই স্নেহভাজন আমীরুল ইসলাম আর আহমাদ মাযহারকে দিয়ে এই প্রস্তাব স্যারের কাছে পেশ করা হবে। আমীরুল আর মাযহার স্যারের ক্লাসরুমের ছাত্র এবং দীর্ঘদিন ধরে স্যারের সহচর। ওরা আমাদের অনুজ। ওদেরকেই স্যারের কাছে পাঠানো হলো। স্যার ওদের মুখে শুনে শুধু বললেন, সাগর, ইফতেখারের আমার প্রতি শ্রুদ্ধা ও ভালোবাসার তুলনা হয় না। স্যার অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তোমরা তো বোঝই বড় ফ্ল্যাটে বাস করে আমার কী হবে? যেভাবে আছি সেটাই ভালো। জীবন তো কেটে যাচ্ছে। খামোখা জীবনের বোঝা বাড়িয়ে কি লাভ? সাগর আর ইফতেখারের আন্তরিকতার জন্য আমি আবেগে আপ্লুত। ওদের বুঝিয়ে বলো যে, ফ্ল্যাটের কোনো দরকার নাই আমার। ওদের যেন মন খারাপ না হয়। আর হ্যাঁ-বরং ওদের বলো যে, আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের রবীন্দ্র অধ্যয়ন চক্র শুরু করতে চলেছি। কিছু টাকা যদি ওরা দিত তবে পাঠচক্র চালাতে সুবিধা হতো। আমীরুল, মাযহার নিরাশ হয়ে ফিরে আসে। স্যার এখনো হাতিরপুলের সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটেই বাস করেন এবং আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দ্যাখেন। আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এমন মুখের ছবি আমাদের সবসময় প্রেরণা দেয়। লেখক : কথাসাহিত্যিক

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর