সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ : প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ। আর সেই সেতুবন্ধ করতে গেলে আমাদের ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ করতে হবে। গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এসে রেলকে প্রায় গলা টিপে হত্যা করতে চেয়েছিল। রেললাইন সংকোচন শুরুর পাশাপাশি তারা রেলে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। আমরা ক্ষমতায় এসে এখন আবার একে জীবিত করেছি। রেলই এখন মানুষের সব থেকে বড় ভরসা। এখন রেল আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, স্বল্প মূল্যে পণ্য ও জনপরিবহন নিশ্চিত করতে সারা দেশে শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সরকার দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ আরও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সারা দেশে রেল যোগাযোগকে শক্তিশালী করতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের আরও প্ল্যান আছে, একেবারে ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত আমরা রেললাইন নিয়ে যাব। তারও সমীক্ষা আমরা শুরু করব এবং সেই উদ্যোগ নিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা বাংলাদেশে আমরা রেলের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাচ্ছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে কক্সবাজার ও টেকনাফ পর্যন্ত যাবে রেললাইন। তিনি বলেন, ‘রেলপথ, সড়কপথ, আকাশপথ- এসবের উন্নয়নে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। তাতে আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও মজবুত হবে। তাছাড়া ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যখন আমরা সংযুক্ত হয়ে যাব, এটাও আমাদের জন্য বিরাট কাজ হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ। তিনি বলেন, ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে এই দুটোর সঙ্গে যদি আমরা সম্পৃক্ত হতে পারি তাহলে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বাড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের যোগাযোগ বাড়বে। কাজেই আমাদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হবে। জাতির পিতাকে হত্যার পর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো রেলের ওপরও আঘাত এসেছিল জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ওই সময় যারা অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিল তারা দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা না করে ক্ষমতাকে ভোগ করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলায় ব্যস্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণে জাপানের সহায়তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জাপান সরকার সব সময় আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। যমুনায় রেলসেতু নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত। কারণ এক সময় এখানে সেতু করার ব্যাপারে আমাকে অনেক তর্ক করতে হয়েছে, অনেক দেনদরবার করতে হয়েছে। আজকে একটা আলাদা সেতু হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি এতে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি তো হবেই, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা আরও সমৃদ্ধ হতে পারব, যা আমাদের দেশকে ভবিষ্যতে আরও উন্নত করবে।

জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি সেটা করব। কারণ জাপানের মতো বন্ধু যাদের সঙ্গে আছে তাদের আর চিন্তার কিছু  নেই, সেটা আমি বলতে পারি। রেল যোগাযোগের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, যমুনায় আজকে আমরা যে রেলসেতু করতে যাচ্ছি শুধু এটা নয়, আগে যেখানে তিস্তা রেলসেতু, সেখানে কিন্তু গাড়ি যাওয়ার সেতু ছিল না। আমি সরকারে আসার পরই ওখানে গাড়ি যাওয়ার জন্য আলাদা সেতু করে দিই। নইলে রেল এসে দাঁড়াত, রেললাইনের ওপর দিয়ে গাড়ি পার হতো। আমি বললাম এভাবে তো হতে পারে না। আমরা আলাদা সেতু করে দিই। ভৈরব নদীর ওপর যে সেতু সেখানেও কিন্তু রেললাইনের ওপর দিয়েই গাড়ি পার হতো। আমরা সেখানে আবার নতুন সেতু করে দিয়েছি। কালুরঘাটেও নতুন রেলসেতু আলাদা এবং সড়কসেতু করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা স্বাগত বক্তৃতা করেন। মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। গণভবন প্রান্তে এবং মূল অনুষ্ঠানস্থলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ, স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী জাপানের জাইকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ জনগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ওপর একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হচ্ছে ডাবল লেনের ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই রেলসেতুটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে জাইকা। ২০২৫ সাল নাগাদ এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

জাইকার অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে সেতু : যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে ডাবল লেনের এই রেলসেতু নির্মিত হচ্ছে জাইকার অর্থায়নে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার রেল যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাবল-লাইন ডুয়েল গেজবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন গতকাল। এই সেতুটি নির্মিত হলে এটি হবে দেশের বৃহত্তম একক রেলসেতু। মূল সেতু দুটি প্যাকেজের অধীনে নির্মিত হবে। পূর্ব ও পশ্চিম অংশের নকশা ও অবকাঠামো কাজের জন্য যথাক্রমে ওবায়াশি-টোয়া জেএফই, জাপান এবং আইএইচআই-এসএমসিসি জেভি, জাপান- এর সঙ্গে দুটি পৃথক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুসারে চলতি বছরের জুলাইয়ে উভয় ঠিকাদারের কাছে জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। নতুন সেতুর ওপর দিয়ে ব্রডগেজ লাইনে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার এবং মিটার গেজ লাইনটিতে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে রেল চলতে সক্ষম হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু নির্মিত হলে ৮৮টি রেল চলাচল করতে সক্ষম হবে। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকার অনুমোদিত প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) থেকে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে এবং ২ হাজার ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে আসবে। এই ডুয়েল গেজ ডাবল-ট্র্যাক সেতুটি দেশের বৃহত্তম ডেডিকেটেড রেলসেতু হতে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ২৫ থেকে ২৮ মে টোকিও সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জাপানকে এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। পরে ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ঢাকা সফরে এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি আবারও উত্থাপন করেন এবং এতে অর্থায়ন করতে রাজি হয় জাপান সরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর