মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জাতীয় মানসকাঠামো গঠনে ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করুন

হাসানুল হক ইনু

জাতীয় মানসকাঠামো গঠনে ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস ঘোষণা করুন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে ১৯৭১ সালের পরাজিত পাকিস্তান-আদর্শের রাজনীতির যে পুনরুত্থান ঘটে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে তা জগদ্দল পাথরের মতো আরও জোরেশোরে চেপে বসে বাংলাদেশের জনগণের ঘাড়ে। এ পাকিস্তান-আদর্শ পরবর্তী ২৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সামরিক-বেসামরিক শাসকদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আরও বিকশিত হয় ও ডালপালা ছড়ায়; আর ১৯৯৯ সাল থেকে তা জঙ্গিবাদে উত্তীর্ণ হয়ে এক নতুন গুণগত মাত্রা ও পরিমাণগত বিস্তৃতি পায়। জামায়াত-বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে চারদলীয় ঐক্যজোট আর সারাদেশে সূচিত হয় জঙ্গিবাদের সশস্ত্র হামলা। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালক-সংগঠক-সমর্থক শক্তির অনৈক্য ও বিভক্তি আর বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তির সুযোগে এবং আগের ৩০ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি শিক্ষা না নেওয়ার ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বে চারদল ক্ষমতাসীন হয়।

চারদল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে সারাদেশে সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে জঙ্গি সংগঠন ও আক্রমণ প্রকাশ্য রূপ লাভ করে এবং এদের হামলার তীব্রতা পায়, সরকার ও জঙ্গির মৈত্রীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালক-সংগঠক-সমর্থক শক্তির নেতা-কর্মীদের হত্যা করা শুরু হয়, ইতিপূর্বে সূচিত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কার্যক্রম সরকার কর্তৃক প্রায় স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, জঙ্গি-সরকার-দল কর্তৃক জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর ধর্ষণ-হত্যা ও বিবিধ আক্রমণ শুরু হয়, আবারও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও ধামাচাপা দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়, আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা ও খাটো করা শুরু হয়, প্রশাসনের রাজনতিক কর্তৃত্ব গ্রহণ করার পরও অর্থের বিনিময়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিয়োগ-বদলিবাণিজ্য শুরু করা হয় ইত্যাদি।

এরকম পরিস্থিতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলে চারদলের সরকার অপসারণের আহ্বান জানায়। এ ধারাবাহিকতায় সর্বপ্রথম ২০০৩ সালের ১২ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ রাজনৈতিক চুক্তিকে সম্প্রসারিত করার জন্য জাসদ কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বিবিধ সৃজনশীল কর্মসূচি পালন শুরু করে এবং কাঠামোবদ্ধহীন বা কোনো একক ফোরামহীন বিচ্ছিন্ন-বিভক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নির্দলীয়-রাজনৈতিক ছাতার নিচে সমবেত ও সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এসব উদ্ভাবনী কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাসদ ২০০৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদেও সংগঠিত করে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে। এসব জাতীয় ও আঞ্চলিক  কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের শক্তির সংগঠিত ‘শক্তি-প্রদর্শন’ করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সকাল ১০টায় পল্টন ময়দানে আয়োজন করা হয় ‘মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ’।

এ মহাসমাবেশ উপস্থিত ১০ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে জাতীয় পতাকার লাল-সবুজের উত্তরীয় প্রদান করে, এবং এ মাটির স্বাধীনতা অর্জনে তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তাঁদের বাংলাদেশের মানচিত্রের টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলক প্রদান করে। মহাসমাবেশ ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিসরে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয় এবং সেজন্য বছরব্যাপী প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, জাসদ এ মহাসমাবেশের আয়োজক হলেও তা ছিল সব দল-মত নির্বিশেষে সব মুক্তিযোদ্ধার শক্তি সমাবেশ; আর এ শক্তি সমাবেশকে ব্র্যান্ডিং করা হয় জাতীয় পতাকার লাল-সবুজে। মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্সের প্রধান সেক্টর কমান্ডার সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ বীরউত্তম, সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সিআর দত্ত বীরউত্তম, সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী বীরউত্তম, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর চার সেক্টর কমান্ডারের দুজন আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সে সময়কার সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র অন্যতম প্রধান রাশেদ খান মেনন এবং জাসদ সভাপতি ও বিএলএফ-এর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রধান হাসানুল হক ইনু।

সারাদেশ থেকে আগত ১০ হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধার এ মহাসমাবেশ ঘোষণা করে যে, “মুক্তিযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সুনির্দিষ্ট অতীত ও ইতিহাস, রাজনৈতিক আদর্শ-দর্শন-লক্ষ্য, নেতৃত্ব, শত্রু-মিত্র ও পক্ষ-বিপক্ষ ছিল।... মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। সমগ্র জনগণের যুদ্ধ। স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসঘাতক ছাড়া তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি জনগণই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন।... স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু, কারিগর মুক্তিযোদ্ধাগণ আর মালিক জনগণ।... একটি স্বাধীন এবং শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট স্বপ্ন ও লক্ষ্যকে সামনে রেখেইে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।... দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমরাই একমাত্র জাতি সৌভাগ্যবান জাতি যে জাতি ভাষাভিত্তিক আধুনিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা পৃথিবীর দুটি সৌভাগ্যবান জাতির একটি যাদের লিখিত স্বাধীনতার ঘোষণা আছে। যে ঘোষণার বলে আমরা স্বাধীনতার জন্য সরকার গঠন করেছি এবং যে ঘোষণার ভিত্তিতে পরবর্তীতে সংবিধান রচনা করেছি। যে ঘোষণার ভিত্তিতে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করছি।” মহাসমাবেশ ‘গভীর বেদনা ও তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ’ করে যে ‘যে স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন’, স্বাধীনতার পর বিগত বছরগুলোর মাথায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সেই স্বপ্ন ও লক্ষ্য পর্যুদস্ত’। “আজও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। জনগণ শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়নি। দারিদ্র্য, অনাহার, বেকারত্ব, জান-মাল-ইজ্জত-জীবিকার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন কাটছে। সন্ত্রাস-দুর্নীতি-লুণ্ঠন-ক্ষমতার অপব্যবহার [ও] জুলুম-নির্যাতন দেশের স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংবিধান-রাষ্ট্র-প্রশাসন-সমাজ-অর্থনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্র থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য ও স্বপ্ন নির্বাসিত।... মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হলেও তারা অবহেলিত, অসম্মানিত। মুক্তিযোদ্ধাদের করুণা বা ভিক্ষার পাত্র বানানো হয়েছে। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বদল, মুক্তিযুদ্ধের নেতা বদল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতা বদল আজ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যারাই ক্ষমতায় আসে তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চালায়।... অন্যদিকে চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা আজ সম্মানিত। বিগত ... বছরে শুধু ক্ষমতার জন্য নীতিহীন রাজনীতিতে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের পার্থক্য মুছে ফেলার আত্মঘাতী রাজনৈতিক কৌশলের সুযোগেই চিহ্নিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা ফিরে এসেছে।... ১৯৭১ সালের মতোই এরা শুধু জাতিকে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্তই করছে না, এরা আজ জাতীয় ঐক্য [ও] রাষ্ট্রীয় অখ-তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-গণতন্ত্র-মানবতা-মনুষ্যত্ব-সভ্যতা-আধুনিকতা-প্রগতির ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হয়েছে।” মহাসমাবেশ মনে করে, “... বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কারিগর। মুক্তিযুদ্ধকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বাংলাদেশ চলতে পারে না। ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থ।” এ মহাসমাবেশ থেকে একটি ২৬ দফা দাবিনামা উপস্থাপন করা করা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে সংবিধান-রাষ্ট্র-রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; সর্বস্তরে জনগণের স্বশাসন কায়েম করা; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করা; সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ফতোয়াবাজি বন্ধ করা; গণহত্যা-গণধর্ষণ-যুদ্ধাপরাধ-মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা; মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় বীরদের কারও সঙ্গে কারও তুলনা না করে যার যার অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া; একটি জাতীয় কমিশন গঠন করে জাতীয় নীতিমালার ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন এবং মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় সম্মান ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করা; মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনা ও ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি-মর্যাদা প্রদান করা; রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মুক্তিযোদ্ধার নামের আগে ব্যবহারের জন্য ‘জাতীয় বীর’ উপাধি প্রদান করা; এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম দিন ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা ও জাতীয়ভাবে পালন করা।

১২ জানুয়ারির এ ‘মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ’-এর পর ২০০৪ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কে এম শফিউল্লাহ, সিআর দত্ত, সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল জলিল, রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুকে সদস্য করে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি বাস্তবায়ন এবং মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটি’ ঘোষণা করা হয়। এ সংবাদ সম্মেলন থেকে জেলা-উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে অনুরূপ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সংবাদ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৬ দফা দাবিতে ১৫ জুলাই ‘মুক্তিযোদ্ধা দাবি দিবস’ পালন করা হয়।

ইতিমধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেসময়ের বিরোধী দলীয় নেতা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও অপরাপর নেতৃত্বকে জানে মেরে ফেলতে দল-সরকার-প্রশসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগের সভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে ২৪ জন মারা যান। ধারাবাহিক অপরাপর হত্যা-হামলার সঙ্গে সঙ্গে এ ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে আরও অনিবার্য করে তোলে। ১ ডিসেম্বর সব জেলা-উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ-র‌্যালি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ, ছাত্রছাত্রীদের রচনা-প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, শিশু-কিশোরদের কুচকাওয়াজ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অভিবাদন প্রদান, শহীদ-সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করা হয়। সর্বত্র বিবিধ আয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ও বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও পাকিস্তান-আদর্শের রাজনীতির বিরুদ্ধে শপথবাক্য পাঠ করেন।

২০০৪ সাল মুক্তিযুদ্ধের শক্তিগুলোর আদর্শিক-রাজনৈতিক ঐক্যের সূচনা করে এবং পরের বছর ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দল আত্মপ্রকাশ করে। ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জামায়াত-জঙ্গি-তেঁতুলমাতা বিএনপির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সংশ্লিষ্টতাকে ছিন্ন করে দেয়; উপরন্তু বিএনপি ও এর রাজনৈতিক ঐক্য চারদলকে দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে আদর্শিক-রাজনৈতিক ১৪ দল ও নির্বাচনী সমঝোতার মহাজোট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে ও পরের দুটো নির্বাচনেও বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। দেশকে অর্থনৈতিক-সামাজিক সূচকে এগিয়ে নেওয়া হয় এবং রাজনৈতিকভাবে জামায়াত-বিএনপি-জঙ্গি-তেঁতুলদের কিছুটা কোণঠাসা করা হয়। বিএনপি-জামায়াত-জঙ্গি-তেঁতুলের বিরুদ্ধে এ রাজনৈতিক-আদর্শিকঐক্য অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির রাজনৈতিক-আদর্শিক অবস্থান গ্রহণও আজ আবশ্যক হয়ে উঠেছে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের শক্তির এ ঐক্য অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

২০০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর ধরে সারাদেশে ১৬ বার বেসরকারিভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যপ্রসূত রাজনৈতিক ঐক্য, আর এ রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের নীতিমালার প্রতি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যথাযথ সম্মান-শ্রদ্ধা জানানো আমাদের কর্তব্য। সেজন্য গত ১৬ বছর ধরে বেসরকারিভাবে যে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালন করা হচ্ছে তা সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে জাতীয়ভাবে ঘোষণা করা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। এ জাতীয় দিবসে জাতীয় ছুটি ঘোষণার প্রয়োজন নেই। অপরাপর কিছু জাতীয় দিবসের মতো [যেমন গণহত্যা দিবস ও বুদ্ধিজীবী দিবস] এ দিনও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনগুলোর বাণী-বিবৃতি প্রদান, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাকার বিবিধ কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা যেতে পারে। আমাদের শহীদ দিবস, গণহত্যা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস ও বিজয় দিবসের সঙ্গে সঙ্গে ১ ডিসেম্বরের ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ জাতীয় বীরদের প্রতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ এনে দেবে ও তাঁদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরার ‘জাতীয় মানসকাঠামো’ গড়ে তুলতে অপরিমেয় ভূমিকা রাখবে। জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়েই রাজনীতি-অর্থনীতি-জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-জীবনবোধ সর্বত্র নতুন নতুন ‘জাতীয় বীর’ তৈরি হবেন।

* লেখক : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি; সংসদ সদস্য; সাবেক তথ্যমন্ত্রী; তথ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর