বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

টেন্ডার ছাড়াই টিকা কিনবে বাংলাদেশ

মানিক মুনতাসির

করোনা মহামারীতে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জরুরি গুরুত্ব বিবেচনায় কোনো দরপত্র ছাড়াই সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন কিনবে সরকার। এর আওতায় যত প্রয়োজন ঠিক তত পরিমাণ ভ্যাকসিন কেনা হবে। তবে প্রথম ধাপে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে সরকার। এর অংশ হিসেবে ১৬ নভেম্বর ভ্যাকসিন কিনতে ৬৩৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ।        

স্বাস্থ্য বিভাগ করোনার ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে চেয়েছিল ১ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের ভ্যাকসিন কিনতে প্রয়োজন হবে ১৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়ার আশা করছে সরকার। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ইতিমধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা) সহায়তা অনুমোদন করেছে। এ ছাড়া ভ্যাকসিন কার্যক্রম প্রচারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, প্রথম দফায় বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন পাবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকরা। অবশ্য এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। সরকার দেশের সব মানুষকে বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন দিতে আগ্রহী। তবে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য কমপক্ষে সাড়ে ১৬ কোটি ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে। প্রতিজনকে ভ্যাসকিন দিতে হবে দুই ডোজ করে। প্রতি ডোজ করোনার ভ্যাকসিন কিনতে সরকারের খরচ পড়বে ৪ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৩৯ টাকা। আর তা জনসাধারণের কাছে বিক্রি করা হবে ৫ ডলারে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪২৩ টাকা। তবে এটাও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।

জানা গেছে, কোনো দুর্যোগ, মহামারী বা যে কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মানুষের জীবন রক্ষায় কোনো জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আন্তর্জাতিক কিংবা দেশীয় বাজার থেকে দরপত্রবিহীন যে কোনো জিনিসপত্র কেনার এখতিয়ার রয়েছে। তখন সেটাতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। করোনার ভ্যাকসিন কেনার ক্ষেত্রে সেই নীতিই অনুসরণ করতে যাচ্ছে সরকার। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্টেও (পিপিআর) সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির কথা বলা আছে। সে নীতি অুনসারেই গতকাল অর্র্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এমন একটি প্রস্তাবের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। এদিকে করোনার ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য সরকার ইতিমধ্যে ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তিও করেছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করেছে সরকার ৫ নভেম্বর। সমঝোতা অনুযায়ী, সিরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে অক্সফোর্ডের তৈরি সার্স-কভ-২ এজেডডি ১২২২ (অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন) [SARS-Cov-2 AZD 1222 (OXFORD/ASTRAZENECA VACCINE)] সরবরাহ করবে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ভ্যাকসিন তৈরি হলে প্রথম দফাতেই বাংলাদেশকে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেবে সিরাম ইনস্টিটিউট। এই ভ্যাকসিন বাংলাদেশে নিয়ে আসবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। যখন এটা তৈরি হবে তখনই বাংলাদেশকে প্রথম সুবিধামতো সময়ে দেবে সিরাম। বেক্সিমকো এই ভ্যাকসিন আনার ব্যবস্থা নেবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ডিপোতে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। অবশ্য ভ্যাকসিন পরিবহন, সংরক্ষণ, প্রয়োগ-সংক্রান্ত হাতে-কলমে কোনো প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতির কাজ এখনো শুরু করেনি সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিটি দেশই নিজেদের অবস্থান থেকে চেষ্টা করছে ভ্যাকসিন তৈরি এবং তা পাওয়ার। যে কোনো ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগের আগে তা নিরাপদ ও কার্র্যকর কি না সেটি ঠিক করা হয়। এখানেও তা-ই হচ্ছে। এ জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এর লাইসেন্স দেবে। আবার বিপণনের জন্যও লাগবে অনুমোদন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও এর অনুমোদন দিতে হবে। সর্বশেষ যে দেশ তার জনসাধারণের জন্য এটা ব্যবহার করবে, সে দেশকেও এর অনুমোদন দিতে হবে।

তিনি বলেন, এরপর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি দেশের ২০ শতাংশ মানুষ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাবে। এ ক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে থাকবেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এখানে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে দরিদ্র দেশগুলোর জিএভিআইর অর্থায়নের মাধ্যমে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে, যা থেকে বাংলাদেশও এ সুবিধা পাবে।

অর্থ বিভাগের অপর একটি সূত্র জানায়, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে পে-উইদাউট পে উভয় পন্থায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশই এখনো নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদনের শতভাগ নিশ্চয়তায় পৌঁছতে পারেনি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো (নিম্ন মধ্য আয়ের) বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন পাবে, যার তালিকায় বাংলাদেশের নামও রয়েছে। জাতিসংঘের আর্টিক্যাল অনুযায়ী যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলারের নিচে, সেসব দেশ এ ধরনের মহামারীর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন পাবে। তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশই বিনা পয়সায় কাউকে ভ্যাকসিন দেয় না, দেবেও না। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএইড, যুক্তরাজ্যের সহায়তা সংস্থা ইউকেএইড, বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিএফআইডিসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী বা অর্থায়নকারী কোনো প্রতিষ্ঠান বা দেশ এসব দেশকে অনুদান কিংবা সহায়তা হিসেবে ভ্যাকসিনের মূল্য পরিশোধ করবে এমন প্রথা চালু রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা দেশ মূল্য পরিশোধ করবে উৎপাদনকারী বা বিপণন প্রতিষ্ঠানকে। কভিডের ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এমন নিয়মই কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য এ সুবিধার অংশ হিসেবেই উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর