শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ

আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল

নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট

বহুল আলোচিত সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ মামলায় আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম মো. আবুল কাশেমের আদালতে চার্জশিট দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। একই ঘটনায় ভিকটিমের স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া এবং স্বামীকে মারধরের ঘটনার মামলার চার্জশিটে একই আসামিদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া অস্ত্র আইনের একটি মামলার চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে দুজনকে। আসামিদের প্রত্যেকেই কারাগারে রয়েছেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে চার্জশিটে ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এরা হলেন- সাইফুর রহমান, শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ও মিসবাউল ইসলাম রাজন। ধর্ষণে সহযোগিতায় অভিযুক্ত হয়েছেন মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল ইসলাম। এসব অভিযুক্ত প্রত্যেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদিকে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে এমসি ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার সময়

ভিকটিমের স্বামীকে মারধর করা হয়। ভিকটিমের স্বর্ণের চেইন ও কানের দুল এবং ২ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় অভিযুক্তরা। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলায় ওই আটজনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। গণধর্ষণের ঘটনার রাতে পুলিশ ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে সাইফুর রহমানের কক্ষ থেকে একটি পাইপগান, চারটি রামদা ও দুটি চাকু উদ্ধার করে। পরে অস্ত্র আইনে পৃথক আরেকটি মামলা করে পুলিশ। ওই মামলায় অবৈধ অস্ত্রগুলোর সঙ্গে সাইফুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান রনির সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পৃথক আরেকটি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে আদালতে।

সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) সুহেল রেজা জানান, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ, ভিকটিমের স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেওয়া ও তার স্বামীকে মারধর এবং অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলায় পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। সিলেট মহানগর পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ জানিয়েছেন, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাতে নিশ্চিত হয়, সে জন্য ঘটনাস্থলের আলামত, বাদী ও ভিকটিমসহ অন্যান্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য, আসামিদের জবানবন্দি, ডিএনএ প্রতিবেদন, আইনগত দিক সব বিশ্লেষণ করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের এপিপি সৈয়দ শামীম জানিয়েছেন, মামলাটির বিচারকাজ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হতে পারে। পরবর্তী শুনানিতে এ বিষয়ে মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত থেকে নির্দেশনা আসতে পারে।

এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, মামলার আসামিদের ডিএনএ টেস্টের প্রতিবেদন না পাওয়ায় চার্জশিট দাখিলে বিলম্ব হচ্ছে। সেই প্রতিবেদন গত রবিবার হাতে পায় পুলিশ। ডিএনএ টেস্টে ধর্ষণের সঙ্গে মামলার আসামিদের শনাক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যারাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ওই তরুণী (২৫)। করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকা ছাত্রাবাসে ওই তরুণী ও তার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ করা হয় তরুণীকে। ওই রাতেই তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে ছয়জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাত ৩-৪ জনকে আসামি করে নগরীর শাহপরান থানায় মামলা করেন। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। পরে ধর্ষণবিরোধী আইন সংশোধন করে মৃত্যুদন্ডের বিধান সংযুক্ত করে সরকার।

এদিকে, মামলার পর গত ১ ও ৩ অক্টোবর সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই আট আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠায় পুলিশ। পরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন এসে পৌঁছে সিলেটে।

এদিকে, গ্রেফতার আসামিদের প্রত্যেককে পর্যায়ক্রমে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তন্মধ্যে সাইফুর, তারেক, রনি ও অর্জুন ধর্ষণের কথা স্বীকার করে। ধর্ষণে সহায়তার কথা স্বীকার করে রবিউল ও মাহফুজুর। অন্য দুজনও জবানবন্দি দেয় আদালতে। ধর্ষণের শিকার তরুণীকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে তিন দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়।

করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্রাবাসও বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু ছাত্রাবাস খোলা থাকা ও সেখানে ন্যক্কারজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে কলেজের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক করে ২৬ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। ১০ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। তবে সেটি প্রকাশ করা হয়নি। এদিকে ২৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) মো. শাহেদুল খবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয় ১ অক্টোবর। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্রের পরিচালক গোলাম রাব্বানীকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ কার্যদিবসে কমিটি জমা দেয় প্রতিবেদন। গণধর্ষণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের হাই কোর্ট বেঞ্চ। ১৯ অক্টোবর ১৭৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন ওই বেঞ্চে দাখিল করা হয়। এসব তদন্ত কমিটির কোনোটির প্রতিবেদনই প্রকাশ করা হয়নি। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ১২ অক্টোবর সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিল করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর