শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জয় বাংলা স্লোগান আর পুরনো অস্ত্র দিয়ে সেদিন ওদের পরাস্ত করি

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী

জয় বাংলা স্লোগান আর পুরনো অস্ত্র দিয়ে সেদিন ওদের পরাস্ত করি

একাত্তরে আমি মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করি।

গাড়ি নিয়ে রেসকোর্সে এসেছিলাম ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে। এটা দেশদ্রোহিতা না হলেও চাকরি খোয়ানোর মতো অপরাধ। আন্দোলনের জোয়ারের মধ্যে আমি বসে থাকতে পারিনি। ভাষণ শুনে ফেরত যাওয়ার সময় দেশে অসহযোগ আন্দোলন চলছে। বঙ্গবন্ধুর আদেশ সবাই মানছিল। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা হওয়ায় একটা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের আদেশ মানা ছিল বড় গর্হিত কাজ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সাহস দিয়েছিলেন বলে পেরেছিলাম। অসহযোগ আন্দোলন এত দূর গেল যে, ছাত্ররা এসে আমার কাচারিতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পতাকা তুলে দিল। সরকারের কর্মকর্তা হওয়ায় আমরা জানতে পারছিলাম সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এনে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য জড়ো করছে। মেহেরপুর তখন কুষ্টিয়া জেলার অংশ। কুষ্টিয়ায় বড় একটা সেনা ইউনিট এসেছিল। আমরা ভাবছিলাম কী করব। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে। আমরা সেভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। মেহেরপুরের রাজনীতিকদের সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। আনসার, মুজাহিদ- এদের এনে প্রশিক্ষণ শুরু করি। গোলাবারুদও দিয়ে দেওয়া হলো তাদের। বলা হলো আক্রমণ হলে একসঙ্গে প্রতিহত করতে। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও জনতার সঙ্গে মিশে যাই। ২৫ মার্চ রাতে এক পুলিশ পরিদর্শক এসে বললেন, স্যার, শুনলাম রাজারবাগে বড় ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গে সঙ্গে থানায় গিয়ে ওয়্যারলেসে জিজ্ঞাসা করলাম। ওপাশ থেকে বলল, ‘সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে’। পরে আর কোনো কথা নেই। হয়তো ভদ্রলোক মারা গেছেন। বুঝতে বাকি রইল না কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি সবাইকে নিয়ে মেহেরপুরে সভা করলাম। ভাবলাম এত বড় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমাদের অস্ত্র লাগবে। ২৬ মার্চ সকালেই ভারতের কাছে খোলা চিঠি লিখলাম। বেশ কয়েকটি চিঠি লিখে চোরাকারবারিদের হাতে দিয়ে বললাম মিডিয়ার লোক আর সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে দিতে। তারা গিয়ে মিডিয়ার লোকদের দিল। একটি চিঠি সীমান্তসংলগ্ন নদীয়া জেলার ডিসির কাছে পৌঁছায়। আরেকটি যায় বিএসএফের স্থানীয় অধিনায়ক (সিও) কর্নেল চক্রবর্তীর কাছে। দুটি চিঠিতেই ছিল আমার স্বাক্ষর ও সরকারি সিলমোহর। একটি চিঠি ২৭ মার্চ অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে ভারত প্রশাসন আমাদের মতো কর্মকর্তাদের বিদ্রোহকে প্রথমে বুঝতে পারেনি। তাদের প্রশ্ন ছিল- কেন আমরা বিদ্রোহ করছি? একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তো আরও ব্যাপক! আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হই আন্দোলনের গভীরতা। কিছু না জেনেই আমার মতো কর্মকর্তা বা পুলিশ অফিসার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, এটাই ছিল ঘটনার গভীরতার প্রমাণ। পরে তারা অস্ত্র দিতে রাজি হয়। তাদের আমন্ত্রণে ২৯ মার্চ ভারতে যাই। এ সময় তাজউদ্দীন সাহেব ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এ পথ দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলেন। সাহায্য চাইলেন। আমি তাদের নিয়ে গেলাম। তাদের দুজনকে পেয়ে ভারতের প্রশাসনিক ও সেনা কর্মকর্তারা আশ্বস্ত হলেন। এর আগে তারা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি তো চাকরিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোথায়?’ ভারত আমাদের কিছু অস্ত্রশস্ত্র দেয়। আমাদের সঙ্গে বিডিআর সদস্য, মেজর ওসমান, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীসহ অনেকে যোগ দেওয়ায় শক্তি বেড়েছিল। ৩০ মার্চ আমরা কুষ্টিয়া আক্রমণ করি। জয় বাংলা স্লোগান আর পুরনো অস্ত্র দিয়েই আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করি। একজন বাদে ওদের সবাই মারা যায় সেদিন। কুষ্টিয়া বিজয়ের পর আরও অনেক এলাকা মুক্ত করি। এপ্রিলে পাকিস্তান বাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় আমরা পিছু হটতে শুরু করি। ঠিক তখনই ঘোষণা এলো আমাদের সরকার শপথ গ্রহণ করবে। তাজউদ্দীন সাহেবের ফোন এলো। জানানো হলো, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে একটি অনুষ্ঠান হবে। তবে খুবই গোপনে। ওইদিন ৫০টি গাড়িতে সবাই এলেন। আমি সমন্বয়কের ভূমিকায়। তখন আমার সুযোগ হয়েছিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। আমি তখনকার বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ও তাজউদ্দীন সাহেবের আলাপ করিয়ে দিই। জায়গাটা শহরের কাছে হওয়ায় ভয় ছিল। পাকিস্তান আর্মি মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গায় তখন তুমুল আক্রমণ চালাচ্ছে। ভরসা ছিল আমবাগান হওয়ায় তারা বিমান থেকে দেখতে পাবে না। দ্বিতীয়ত, তাদের ইন্ডিয়ান টেরিটরির ভিতর দিয়ে আসতে হবে। যতটুকু সম্ভব প্রহরা বসালাম। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে শপথ হলো। ঠিক হলো বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালন করবেন। পাশেই পলাশী, যেখানে সিরাজউদ্দৌলাকে হারানো হয়েছিল। আমরা সেখানে নতুন সরকার পেলাম। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ক্রমেই সাংগঠনিক রূপ পায়।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর