ভৌগোলিক কারণে ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধ ছিল মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জন্য সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তপ্ত এই রণাঙ্গনে ছিল উভয়ের জন্য মর্যাদার লড়াই। ফেনীর বুক চিরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক রেলপথ ঢাকা পর্যন্ত প্রসারিত। একাত্তরের মার্চে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাড়তি অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈন্য (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে) ফেনীর ওপর দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানিদের। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানিদের বাড়তি সৈন্য ও গোলাবারুদ যেন ফেনীর ওপর দিয়ে দেশের অন্য অঞ্চলে যেতে না পারে। বৃহত্তর নোয়াখালীর সাব-সেক্টর ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক হিসেবে আমার ওপর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়। আমার সঙ্গে শুরুতে তৎকালীন ক্যাপ্টেন ইমাম উজ জামান, ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ, ক্যাপ্টেন শহীদ, ক্যাপ্টেন মজিবুর রহমান, লে. দিদার, লে. মিজান, ক্যাপ্টেন মোকলেসুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান, হাসান ইমাম, মুক্তিযোদ্ধা ও মেডিকেল অফিসার টু ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজি.। এদের সঙ্গে মিলে সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিভিন্ন পর্যায়ের সৈনিক এই যুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
ফেনী শহরের চারপাশে প্রতিরোধের পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য : পাকিস্তানি সেনারা যেন নোয়াখালী বেগমগঞ্জের চৌরাস্তা হয়ে লাকসাম কুমিল্লার দিকে না যেতে পারে। অথবা ঢাকা-কুমিল্লা থেকে লাকসাম হয়ে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা হয়ে শত্রুপক্ষ উল্টো ফেনীতে তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য কোনো সহযোগিতা করতে না পারে। এজন্য ফেনীর চারপাশ এবং বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় চতুর্মুখী প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। বেগমগঞ্জ চৌরাস্তাকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন এক. সুবেদার লুৎফর রহমান ও গাজী আমিন উল্লাহ দুই. সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ তিন. শ্রমিকনেতা রুহুল আমিন ও চার. সুবেদার সামছুল হক ও সুবেদার এসহাক। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় পরিষদ সদস্য নুরুল হক এবং খাজা আহমেদ। ফেনী জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কালীরবাজার নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ডিফেন্স ঘাঁটি থেকে ১ হাজার গজ দূরে মুন্সিরহাটে ওই ঘাঁটির মুখোমুখি আমরাও প্রায় তিন মাইলব্যাপী ডিফেন্স স্থাপন করি। এটি ছিল ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও গণযোদ্ধাদের প্রথম বিলোনিয়া সম্মুখযুদ্ধ। মুন্সিরহাটে আমাদের ঘাঁটির মাঝে ৭০০ গজ ঘন এন্টিট্যাংক এন্টিপার্সোনাল মাইনফিল্ড স্থাপন করি। হানাদারদের ছিল ট্যাংক, আর্টিলারি, জঙ্গি বিমান ও হেলিকপ্টার এবং ফেনীতে ছিল এক রেজিমেন্টের অধিক সৈন্য অনুকূল সমর্থনে। তাদের এই সক্ষমতার বিরুদ্ধে আমাদের ছিল অসীম মনোবল শত্রু নিধন করে দেশ মুক্ত করার দৃঢ় সংকল্প ও শপথ। ’৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত পাকিস্তানিরা নয়টি আক্রমণ চালায়। আমাদের সামনে স্থাপিত ঘন মাইনফিল্ড ও ভারতীয় আর্টিলারি সমর্থনে ব্যাপক মর্টার ও ভারী অস্ত্র ফায়ারিংয়ের মুখে আমাদের পাতানো ফাঁদ মাইনফিল্ড অতিক্রম করতে পারেনি। এই সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানিদের প্রায় ৩০০ জন হতাহত হয়েছিল। জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী তার বই THE BETRAYAL OF EAST PAKISTAN (page-209) এ স্বীকার করে বলেছেন, ‘A Brigade action which launched at Belonia was repulsed by10 East Bengal Regiment and muktibahini jointly. এটা ছিল প্রথম বিলোনিয়া সম্মুখযুদ্ধে গণযোদ্ধা ও নিউক্লিয়াস অব দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঐতিহাসিক সামরিক অভিযান। পরে অবশ্য রণকৌশলগত কারণে এই ডিফেন্স মুহুরী নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করি এবং দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। উল্লেখ, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তান আর্মির সিজিএস জেনারেল হামিদ ফেনী সার্কিট হাউস থেকে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। সিজিএস জেনারেল হামিদের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণ পাকিস্তানে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘তুমি বলছ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) কোনো মুক্ত এলাকা নেই। আমরা সম্প্রতি ফেনী-বিলোনিয়া ঘুরে দেখেছি, ফেনী-বিলোনিয়া বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত। সেখানে পাকিস্তানপ্রশিক্ষিত একঝাঁক অফিসার, সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে এই মুক্ত অঞ্চল থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে যাতে ফেনী-চট্টগ্রাম থেকে কোনো বাড়তি সৈনিক ও গোলাবারুদ ফেনীর ওপর দিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে যেন না যেতে পারে। এ কথা শুনে ইয়াহিয়া জেনারেল হামিদকে পাঠান। সেই সফল উইথড্রয়ালে প্রাণরক্ষা করেছিল পাঁচ শতাধিক গণযোদ্ধা এবং একটি ব্যাটালিয়নের প্রায় ১৭০০ মুক্তিযোদ্ধার। মুহুরী নদীর ডিফেন্স অবস্থায় রাজনগর ও বগ কাচারিতে গণযোদ্ধা ও দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা প্রায় প্রতিদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থান ঘাঁটি ও অঞ্চলগুলোর ওপর রেইড, অ্যামবুশ, আর্টিলারির মাধ্যমে আমাদের ফায়ার অব্যাহত থাকে এবং তাদের ঘাঁটিগুলো অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এ ছাড়াও হাবিলদার জহির বীরবিক্রম ও হাবিলদার ইউনুছের সহযোগিতায় পাকিস্তানিদের মুভমেন্ট স্মিত করার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ের ফেনীর শর্শদি রেলব্রিজ ও হাইওয়ের রাজনকরা ব্রিজটি কমান্ডো গ্রুপ ও সাকি প্লাটুন এক্সপ্লোসিভ দিয়ে বিধ্বস্ত করে চট্টগ্রাম-ঢাকার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিখ্যাত বিলোনিয়া সম্মুখযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের আমরা হিট অ্যান্ড রান কৌশলের মাধ্যমে বিলোনিয়ায় পর্যুদস্ত ও অবরুদ্ধ করে ফেলি। শুরু হয় দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি।
দ্বিতীয় বিলোনিয়া যুদ্ধ : ৫ নভেম্বর অন্ধকার শীতের রাত। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পুরো রাতটা যেন কিছুর প্রতীক্ষায়। রাত ৯টায় অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করি। এমন একটা এলাকা ঘেরাওয়ের অভিযানে নেমেছি যেখানে তিন পাশেই ভারত সীমান্ত। এক প্রান্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম-চিথলিয়ার মাঝ দিয়ে ভারত সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অবরোধ শুরু হলো অন্ধকার রাতে। মুহুরী নদী ও সিলোনিয়া নদীর কোথাও বুক পানি কোথাও পিচ্ছিল রাস্তার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলছিল সবাই। কমান্ডার হিসেবে সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করে গন্তব্যে পৌঁছানো সত্যিই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। প্রথমে মুহুরী নদী অতিক্রম করল লে. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে (বি কোম্পানি), ও লে. দিদারের নেতৃত্বে সি। দুই কোম্পানির পরে দশম ইস্ট বেঙ্গল হেড কোয়ার্টার কোম্পানি ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আগত ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদের নেতৃত্বে আর একটি কোম্পানিসহ আমি নদী অতিক্রম করে সবাই পূর্বনির্ধারিত এলাকায় অবস্থান গ্রহণের উদ্দেশে যাত্রা অব্যাহত রাখি। এদিকে ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মোকলেসুর রহমানের নেতৃত্বে এ ও ডি কোম্পানি চিথলিয়া ঘাঁটি বরাবর রেজিমেন্টের বি/ডি. এইচ কিউ ও দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল কোম্পানির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হতে থাকি। ভোর হলো। আমরাও বাঙ্কারে প্রস্তুত। শত্রুরা সারা দিন আমাদের বিভিন্ন পজিশনের ওপর তুমুল আক্রমণ চালাল। বৃষ্টির মতো আসা শেলিংয়ের শব্দে আশপাশের এলাকা কেঁপে উঠতে লাগল। শত্রুরা এবার পরশুরাম ঘাঁটি থেকে আমাদের ওপর প্রচ- আক্রমণ শুরু করল। উভয় পক্ষের তুমুল গোলাগুলিতে বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ভোর হলো। ভোর হওয়ার আগেই আমরা বাঙ্কার খনন করে শত্রুদের চারপাশে অবস্থান করে তাদের সম্পূর্ণ ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে আসি। আমার নির্দেশ ছিল অর্ডার ছাড়া কেউ ফায়ার ওপেন করবে না। হঠাৎ চিথলিয়া ঘাঁটি থেকে একটি ট্রলিতে সুবেদার লোদি ও আটজন সৈনিকসহ পরশুরাম ঘাঁটির দিকে আসছে। সুবেদার এয়ার আহম্মদ উত্তেজিত হয়ে অর্ডার ছাড়াই ফায়ার ওপেন করে। ওই ট্রলির সবাইকে এলএমজি ফায়ার করে বিধ্বস্ত করে এয়ার আহমেদ বীরবিক্রম ট্রলি থেকে লোদি ও বাকিদের অস্ত্র বাঙ্কারে নিয়ে আসার আগ মুহূর্তে শত্রুপক্ষের এলএমজি ফায়ারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এয়ার আহম্মদ। হঠাৎ দেখলাম তিনটা বিমান আমাদের এলাকায় এসে বোম্বিং শুরু করল। চারদিকে দাউদাউ করে ঘরবাড়ি জ্বলছে। আমরা অপেক্ষায় কখন আমাদের এমএমজির আওতায় বিমানগুলো আসবে। দেরি হলো না। এমএমজি থেকে ছোড়া শুরু হয় তপ্ত বুলেট। দুটি বিমান উড়ে গেল তাদের সীমানায়। তৃতীয় বিমান যখন ফিরে যাচ্ছিল দেখলাম ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। নিশ্চিত হলাম আমাদের এমএমজির ফায়ারিং আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। বিমানটি লাকসাম এলাকার অদূরে ভূপাতিত হয়েছে। রাতেই আমরা পরশুরাম ও বিলোনিয়া দখল করতে সক্ষম হলাম। সকালে দেখতে পেলাম ধানখেতের পানি রক্তবর্ণ। চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে শত্রু বাহিনীর সদস্যদের লাশ আর লাশ। অনেকে জখম। কারও হাত নেই। কারও পা নেই। যারা আহত হয়ে পালাতে চেয়েছিল তাদের পালানো হলো না। আহতদের চিকিৎসা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। দুজন অফিসারসহ ৭২ জন সৈনিক দশম বেঙ্গল তথা মুক্তিযোদ্ধার কাছে আত্মসমর্পণ করল। এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে পাকিস্তানি হানাদারদের মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রথম আত্মসমর্পণ। এই ধারাবাহিকতায় ফেনী-বিলোনিয়া মুক্ত করি। ৬ ডিসেম্বর বীরদর্পে আমরা ফেনীতে প্রবেশ করি। এই যুদ্ধে আমাদের ৩৭ জন যোদ্ধা শহীদ ও ২০০ জন আহত হন। ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বিলোনিয়ার বিখ্যাত এই যুদ্ধ রণকৌশল আজ বিশ্বের বিভিন্ন সামরিক কলেজে পড়ানো হয়।অনুলেখক : শফিকুল ইসলাম সোহাগ