শিরোনাম
সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কাজ চায় রোহিঙ্গারা

বসে না থেকে যে কোনো ধরনের জীবিকার প্রত্যাশা প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসরকারি সংস্থাগুলো

জুলকার নাইন, ভাসানচর থেকে ফিরে

কাজ চায় রোহিঙ্গারা

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খোলামেলা জীবন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভাসানচরের ৬ নম্বর ক্লাস্টারে ঘর পেয়েছে মিয়ানমারের বুচিডং থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া হাসানউল্লাহ। ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। হাসানউল্লাহ বলেন, আমি ড্রাইভিং জানি। যে কোনো গাড়ি চালাতে পারি। আমি একটা কাজ চাই। ড্রাইভিং করা সম্ভব না হলে একটা দোকান চালাতে চাই। পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন শুক্কুর আলী। তিনি বললেন, এখানে অনেক জমি আছে। সেখানে যে কোনো চাষ করা যায়। চাষ করার সুযোগ দিলে চাষ করব। না হলে সেখানে দিনমজুরের কাজ দিলে দিনমজুরি করব। হাসানউল্লাহ ও শুক্কুর আলীর মতো প্রায় জনা পঞ্চাশেক স্থানান্তরিত রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় ভাসানচরে। তারা গত শুক্রবার কক্সবাজার থেকে স্থানান্তর হয়ে ভাসানচরে গিয়েছেন। সেদিন প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গাকে নেওয়া হয় ভাসানচরে। স্থানান্তরিতদের প্রায় সবাই ভাসানচরের ঘর ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেখে মুগ্ধ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও তাদের মধ্যে আছে স্বস্তি। সরকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থার ন্যূনতম কমতি দেখা গেল না কারও মধ্যেই। সরকার যেভাবে বলবে সেভাবেই তারা থাকতে চায়। তবে প্রায় সবাই বললেন, তারা কাজ চান। যে কোনো ধরনের কাজের জন্য তারা প্রস্তুত আছেন। কাজ হলে জীবিকার পাশাপাশি সময়টাও ভালো কাটবে।

মিয়ানমারের নির্যাতনের শিকার হয়ে বাবা ও স্বামী হারানো মোছাম্মৎ ফাতেমাও আশ্রয় পেয়েছেন ভাসানচরে। ফাতেমা বললেন, মিয়ানমার থেকে আসার পর এত শান্তিতে আর কোনো রাত কাটাই নাই। আমি খুবই খুশি। সরকারকে ধন্যবাদ আমাদের জন্য এত সুন্দর বাড়ি ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা কয়েক দফায় প্রকাশ করে ফাতেমা বললেন, আসার আগে সেলাই মেশিন দেওয়ার কথা বলেছিলেন স্যারেরা। যদি দিত তা হলে সেলাই করে কিছু করার চেষ্টা করতাম। মাজেদা বলেন, সরকার যেভাবে খুশিতে রাখছে, আমরা চাই সরকার সেভাবেই আমাদেরকে খুশিতে রাখুক। আমার স্বামীকে একটা কাজ দিলে ভালো হয়। কারণ বসে থাকলে তার মধ্যে নানান খারাপ চিন্তা আসে। যে কোনোভাবে একটা কাজের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন মাজেদা।

মাজেদার বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা গেল ভাসানচরে যাওয়া বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট এনজিও এল্যাইন্স ফর ভাসানচরের কর্মকর্তাদের কথাতেও। তারাও বলছেন, বসে থাকলে অসৎচিন্তা মাথায় আসে। তাই তাদেরকে কাজে লাগানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। তাই সরকারের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কয়েক দফায় আলোচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। বেসরকারি সংস্থা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা বা স্কাস’র চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা জানান, আমাদের মূল ফোকাস আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জীবিকার পথ তৈরি করা। এ জন্য মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, সমন্বিত কৃষি উৎপাদন ইত্যাদির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নারীদের জন্য টেইলরিংয়ের ব্যবস্থা করার চিন্তা করা হচ্ছে। এ জন্য তাদের মাঝে সেলাই মেশিন দেওয়া হবে। সোশ্যাল এজেন্সি ফর ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ সোয়াব-এর চেয়ারম্যান এস এম রাশেদুজ্জামান জানান, ইতিমধ্যেই ভাসানচরে থাকা জলাধারগুলোতে মাছ চাষের বিষয়ে আমরা আগ্রহ প্রকাশ করেছি। সেখানে রোহিঙ্গারা কাজ করবেন। আমরা তাদেরকে পোনা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করব। এ জন্য প্রয়োজনীয় আলোচনা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। এর বাইরে ল্যান্ড কাল্টিভেশন বা জমিতে কৃষিকাজের প্রকল্পও নেওয়া হচ্ছে। ভাসানচরে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে রোহিঙ্গারা ত্রাণ সহায়তার কার্ডের আওতায় খাবার ও রেশন পাওয়ায় তাদের জন্য তেমন কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেই। কিন্তু ভাসানচরে পরীক্ষামূলক জীবিকা নির্বাহ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ব্যবস্থা আছে। এর মধ্যে আছে মৎস্য চাষ, স্থানীয় মুরগি এবং টার্কি মুরগির চাষ, ভেড়া পালন, গবাদিপশু পালন, কবুতর এবং হাঁস পালন, দুগ্ধ খামার, ধান ও সবজি চাষ, হস্তশিল্প, মহিলাদের জন্য সেলাই কাজ, বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং, ট্যুরিজম এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা-। দ্বীপে এখন প্রায় ছয় হাজার মহিষ আছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এসব মহিষের পাশাপাশি সরকারিভাবে প্রকল্প নিয়ে মহিষের দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করা যেতে পারে। এখন ছাগল ও ভেড়া পালনের যে পরীক্ষামূলক উদ্যোগ চলছে সেখানে উৎপাদন বৃদ্ধির হার যথেষ্ট ভালো দেখা গেছে। প্রকল্পের দুটি বিশাল লেকে পরীক্ষামূলকভাবে মৎস্য চাষ করেও সফলতা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া খালি থাকা বিশাল জমিতে যে কোনো ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। ভাসানচর প্রকল্প পরিচালক কমডোর আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, ভাসানচর মোট ১৩ হাজার একরের হলেও মাত্র ১ হাজার ৭০০ একর জমির চারদিকে বাঁধ দিয়ে ৪৩২ একরের ওপর আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনা করা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইজের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। আরও ৯৩২ একর ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফলে এখন এক লাখ রোহিঙ্গাকে এখানে স্থানান্তরের পর, চাইলে পুরো দশ লাখকেই ভাসানচরে ধীরে ধীরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর