শনিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতাদের কাছে ধরনা বঞ্চিতদের

বিদ্রোহীদের না, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সুপারিশে মনোনয়ন তুলতে দলীয় কার্যালয়ে বাড়ছে ভিড়

রফিকুল ইসলাম রনি

পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণে শর্ত শিথিল করায় কেন্দ্রের প্রভাবশালী নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন তৃণমূল থেকে বঞ্চিতরা। তারা বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কিংবা কেন্দ্রীয় নেতাদের সুপারিশে দলীয় ফরম সংগ্রহ করতে ভিড় করছেন সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে। গত দুই দিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয় ও কিছু কিছু কেন্দ্রীয় নেতার অফিসে এমন চিত্র দেখা গেছে। বিদ্রোহীদের ব্যাপারে এখনো কঠোর অবস্থানে দলের হাইকমান্ড। কোনোভাবেই তাদের মনোনয়ন             দেওয়া হবে না। তথ্য গোপন করে কেউ কেউ ফরম তুলছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, তৃণমূল থেকে নাম পাঠানো না হলে কেউ দলের মনোনয়ন ফরম নিতে পারবেন না। সেটি এখন শিথিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতা কিংবা বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সুপারিশে অনেকে তুলছেন মনোনয়ন ফরম।

গতকাল দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয় ঘুরে মনোনয়ন ফরম বিক্রির উৎসবের চিত্র চোখে পড়েছে। কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে কেউ কেউ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করছেন। আবার কেউ কেউ নিজ পৌরসভা বা উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছেন। সভানেত্রীর কার্যালয়ে ভিড় না করার নির্দেশনা থাকায় এবার মিছিল চোখে পড়েনি। তবে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসাবাড়িতে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা গেছে। দ্বিতীয় ধাপে পৌরসভা নির্বাচনে গতকাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ২৬২টি মনোনয়নপত্র বিতরণ করে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জন বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার সুপারিশে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৬২ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জনকে বিভিন্ন নেতার সুপারিশের ভিত্তিতে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছে। যাদের নাম তৃণমূল থেকে আসেনি, আমরা তাদের লিস্ট আলাদাভাবে করে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় জমা দেব। বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে।’  খুলনা বিভাগ থেকে এক নেতা গতকাল এসেছিলেন দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে। স্থানীয় রাজনীতির ‘বলি’ হওয়ায় তার নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়নি বলে তার অভিযোগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই মনোনয়নপ্রত্যাশী বলেন, মাঠ পর্যায়ের সব জরিপে আমিই এগিয়ে আছি। তারপরও স্থানীয় নেতাদের রাজনীতির ‘বলি’ হয়েছি। তাই বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতার কাছে আমার অতীত ও বর্তমান রেকর্ড তুলে ধরেছি। তারা আমাকে সুপারিশ করেছেন। সেই ভিত্তিতেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলাম।

দ্বিতীয় ধাপের পৌর নির্বাচনে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন ছয়জন। প্রার্থী ঠিক করতে ৩ ডিসেম্বর বর্ধিত সভা করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় সভা। পৌর আওয়ামী লীগ স্থানীয় এমপি রেবেকা মমিনের এপিএস তোফায়েল আহমেদকে একক প্রার্থী করে জেলায় নাম পাঠায়। এতে সুপারিশ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। আর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান মেয়র লতিফুর রহমান রতনও আলাদা রেজুলেশন করে নিজের নাম পাঠান জেলা আওয়ামী লীগের কাছে। পরে জেলা আওয়ামী লীগ দুই পক্ষে দুজনের নামই কেন্দ্রে পাঠান। সে অনুযায়ী দল থেকে তাদের কাছে ফরম বিক্রি করা হয়। ফরম বিক্রি শিথিল করায় বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সুপারিশে দলের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন মোহনগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা কামরুজ্জামান, প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কুদ্দুস আজাদের মেয়ে তাহমিনা পারভীন বীথি ও মৎস্যজীবী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজুয়ান আলী খান আর্নিক ও মোহনগঞ্জ উপজেলার দফতর সম্পাদক মো. এমদাদুল ইসলাম খোকন। এ প্রসঙ্গে মোহনগঞ্জ উপজেলার দফতর সম্পাদক মো. এমদাদুল ইসলাম খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের মনোনয়ন ফরম বিতরণে শর্ত শিথিল করায় আমরা সুযোগ পেয়েছি। আমরা রাজনীতি করি প্রার্থী হওয়ার অধিকার যেমন আছে, তেমনি কেন্দ্র থেকে বিতরণকৃত মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ থেকে বঞ্চিত হতে পারি না। নেত্রী আমাদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের সুপারিশে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছি। বাকিটা নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তা-ই মেনে কাজ করব।

মৎস্যজীবী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজুয়ান আলী খান আর্নিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা মোট পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলাম। প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য ৩ ডিসেম্বর বর্ধিত সভা করা হয়। আমাদের দাবি ছিল সবার নাম যেন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বর্ধিত সভা শেষ করা হয়। পরে জানতে পেরেছি, পৌর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং থানা সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় এমপি রেবেকা মমিনের এপিএস তোফায়েল আহমেদ এবং বর্তমান মেয়র থানা সভাপতি লতিফুর রহমান রতনও আলাদা করে রেজুলেশন করে নিজের নাম জেলায় পাঠিয়েছেন। তৃণমূলে গ্রহণযোগ্যতা ও সব যোগ্যতা থাকার পরও বঞ্চিত হয়েছি। সেই কারণে নতুন করে সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছি।   

এ প্রসঙ্গে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ আলী খান খসরু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মোহনগঞ্জ পৌরসভার প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য পৃথক দুটি নাম পাই। একটিতে স্বাক্ষর করেছেন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, থানার সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর করা একক প্রার্থীর নাম। আরেকটিতে থানার সভাপতি নিজে ও দুজন সহ-সভাপতিসহ কয়েকজনের স্বাক্ষর করা  একক নাম। দুটি নামই আমরা কেন্দ্রে পাঠিয়েছি একটি ‘নোট’ দিয়ে। আমরা বলেছি, প্রার্থী বাছাইয়ে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। কেন্দ্র প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে।’  এ প্রসঙ্গে মোহনগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান মেয়র লতিফুর রহমান রতনের কাছে জানতে চাওয়া হয় প্রার্থী বাছাইয়ে কবে নাগাদ বর্ধিত সভা করেছিলেন? জবাবে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি কে প্রশ্ন করার? ফোন রাখেন!। পরে তিনি নিজেই সংযোগ কেটে দেন।’ দ্বিতীয় ধাপের শরীয়তপুর পৌরসভা নির্বাচনে তৃণমূল থেকে নাম পাঠানো হয় পাঁচ নেতার। তারা দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন কোতোয়াল ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাহাড় বঞ্চিত হয়েছেন দাবি করে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে ঢাকায় এসেছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে নুরুল আমিন কোতোয়াল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তৃণমূল থেকে আমাদের নাম পাঠানো হয়নি। তাই আমরা কেন্দ্রীয় নেতার সুপারিশ নিয়ে দলীয় ফরম সংগ্রহ করব।  আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘তৃণমূল থেকে নাম না এলেও যারা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের মনোনয়ন ফরম দেওয়া হচ্ছে। তবে অতীতে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন তাদের ব্যাপারে দলীয় সভানেত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সতর্ক রয়েছি। বিদ্রোহীদের মনোনয়ন কিংবা ফরম দেব না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর