মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

লক্কড়ঝক্কড় বাস রাজধানীজুড়ে

হেডলাইট দরজা জানালার গ্লাস সিট ভাঙা, ভিতরে নোংরা, দুর্গন্ধের মধ্যে চলছে যাত্রী পরিবহন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

লক্কড়ঝক্কড় বাস রাজধানীজুড়ে

রাজধানীতে এরকম লক্কড়ঝক্কড় বাসে বহন করা হচ্ছে যাত্রী -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে উত্তরা রুটে চলে তুরাগ পরিবহন। রামপুরা ব্রিজে যাত্রী তোলার জন্য দাঁড়ানো তুরাগ পরিবহনের বাসে দেখা যায় এর পেছনের অংশে কোনো বাতি নেই। বাসের রং কোথাও উঠে গেছে, কোথাও মরচে ধরা, অসংখ্য ফুটো, কোথাও বা পোস্টার সাঁটানো। পেছনের অংশের মতো সামনের দিকেও বাসের রংচটা, চারটির মধ্যে একটি হেডলাইট নেই। নেই কোনো দিকনির্দেশক বাতি। রাজধানীজুড়ে চলছে ভাঙাচোরা, লক্কড়ঝক্কড় গণপরিবহন। কোনোটি রংচটা, কোনোটির ছাল ওঠা। কোনোটির জানালার গ্লাস ভাঙা, কোনটির আবার দরজাই নেই। কিছু বাসের আসনগুলোরও করুণ অবস্থা। ভাঙা সিটে অনেক সময় যাত্রীদের জামাকাপড় ছিঁড়ে গিয়ে লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেক বাসের ভিতরে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ, সিটে বাসা বেঁধেছে ছারপোকা। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনে চলা যেমন বিপজ্জনক তেমন নগরীর সৌন্দর্যেরও হানি ঘটছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, ‘আমি চালকদের দোষ দেব না। দোষ দেব তাদের যারা বাস রুটের অনুমোদন দেন। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি তারাই তৈরি করে দিচ্ছেন। গুলশানে ঢাকা চাকা নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাস চালাচ্ছে। সেখানে তো যাত্রীরা নিয়ম মেনে বাসে চড়ছেন। ঢাকা চাকার বাসগুলোয় তো আঁচড় পড়ছে না, দুর্ঘটনাও ঘটছে না। গুলশানে এটি সম্ভব হলে রাজধানীর বাকি অংশে কেন অসম্ভব হবে? আসলে প্রয়োজন উদ্যোগ।’

সরকারের নীতিমালা না থাকায় এ সুযোগ নিচ্ছেন বাস মালিকরা। দুই দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় রুট অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী কোনো বাসের রং উঠে গেলে সেটি চলাচলের অনুপযোগী হবে। বিআরটিএর সে সার্কুলার পরবর্তী সময়ে নতুন করে জারি হয়নি। বর্তমানে রাজধানীর ২৯১ রুটে চলা প্রায় ৩০ হাজার বাসের অধিকাংশই রংচটা।

গত তিন দিনে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও গাবতলী রুটে সরেজমিন এমনই দৃশ্য চোখে পড়ে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িরও একই হাল। গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী ও সদরঘাট রুটে চলা ‘৮’ ও ‘৭’ নম্বরের অধিকাংশ বাসেই দেখা যায় কোনোটির গ্লাস ভাঙা, কোনোটির লুকিং গ্লাসই নেই, কোনোটির সামনে ও পেছনের বাম্পার খোলা। কোনোটির জানালার কাচ অর্ধভাঙা হয়ে ঝুলছে, কোনো কোনোটির আবার বডি দোমড়ানো-মোচড়ানো। আবার কোনো কোনো গাড়ি ভাঙাচোরা না হলেও রাস্তায় চলার সময় অন্য গাড়ির সঙ্গে ঘষাঘষির কারণে দু-তিন মাসের মধ্যেই রং উঠে কদাকার। রাজধানীর মৌচাক মোড়ে যানজটে আটকে থাকা এ রকম একাধিক বাস চোখে পড়ে। টঙ্গী-গাজীপুর থেকে উত্তরা হয়ে চলা তুরাগ, ভিআইপি, ছালছাবিল, অনাবিলসহ প্রায় সব কটি পরিবহন কোম্পানির বাস রংচটা, বিবর্ণ ও আঁচড় লাগানো। মিরপুর থেকে চলাচলকারী দিশারি, নিউ ভিশন, বিকল্প, হিমালয়, মিরপুর পরিবহনসহ সব কটি বাসেরই বেহাল দশা।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি রাজধানীর গণপরিবহন দেখে সে দেশের মানুষের সভ্যতা ও রুচির মাপকাঠি নিরূপণ করা হয়। আমরা জাতীয় উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছি। কিন্তু আমাদের রাজধানীর গণপরিবহনের দিকে তাকানো যায় না। বিশ্বের কোনো দেশে এমন অপরিচ্ছন্ন, রুচিহীন যাত্রী পরিবহন দেখা যায় না। এমনকি সরকারি পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)-এর বাসগুলোর বাহ্যিক অবস্থাও অভিন্ন।

ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিআরটিএ থেকে রংচটা বাসগুলোকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। এ কারণে বাস আটকেও জরিমানা করা যায় না। আর জরিমানা করলেও বাস মালিক ও শ্রমিকরা একজোট হয়ে আন্দোলন করেন, সড়কে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেন। তখন যাত্রীরা উল্টো ট্রাফিক বিভাগের ওপর চড়াও হন। বাসের রংচটা বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কারণে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। কারণ বাসের বডি ঝকঝকে রাখার কোনো চেষ্টাই পরিবহনশ্রমিকদের নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, জরিমানা না হওয়ায় বেপরোয়া গতিতে বাসচালকরা প্রতিযোগিতা করে রাস্তায় বাস চালাচ্ছেন। এর শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন কেউ বা চিরকালের মতো পঙ্গু হচ্ছেন। বাস কোম্পানিগুলোর মালিকপক্ষের নিয়মনীতি না থাকাতেই প্রাণঘাতী এ প্রতিযোগিতা।

আমিনবাজার থেকে মিরপুর, কাকলি, নতুন বাজার হয়ে ডেমরা রুটে চলে ‘অছিম পরিবহন’। গতকাল নতুনবাজার স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো এক বাসে দেখা যায় স্টপেজসহ সব লেখা, রং মুছে গেছে, রংচটা, নেই দিকনির্দেশক বাতি, ব্যাকলাইট ভাঙা তো আছেই। তবে বাস থেকে বের হয়ে হাসিমুখে কথা বলতে থাকেন চালক মো. সুমন। বাসের করুণ দশার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এ বাসের বয়স দুই বছর। তয় পাড়াপাড়ি কইরা চলতে হয়। অন্য বাসে ধাক্কা মারে। হুড়াহুড়িতে রং ঠিক থাকে না। মালিকে জরিমানা করে। তয় রং করে না।’

সবচেয়ে করুণ অবস্থা দেখা গেল রবরব পরিবহনের বাসের। এদের বাসগুলো গাবতলী থেকে মিরপুর, কালশী, মাটিকাটা হয়ে রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকা গুলশান ঘুরে যায় নতুন বাজার পর্যন্ত। এ বাসে নেই ডিজিটাল নম্বর প্লেট। কাচ, জানালা ভাঙা, রংচটা। ব্যাকলাইট নেই। ভিতরে সিটগুলো ভাঙা। অনেক সিটের ফোম উঠে গেছে। বাড্ডা লিঙ্ক রোডে বাস থেকে নামতে গিয়ে সিটের ভাঙা অংশে লেগে বোরকা ছিঁড়ে যায় এক নারীর। এ নিয়ে যাত্রীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সুপারভাইজারের ওপর।

আবদুল্লাহপুর, নতুনবাজার, পল্টন, সরদঘাট রুটে চলে ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহন। এ গাড়িতে নিয়মিত খিলক্ষেত থেকে পল্টন যাতায়াত করেন ফরহাদ হোসেন। পল্টনে কার্ডের দোকান রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘বাসগুলোর অধিকাংশের রং উঠে গেছে, বিভিন্ন জায়গায় জোড়াতালি দেওয়া। বাসের ভিতরে নোংরা, অনেক সময় প্রস্রাবের গন্ধ নাকে লাগে। সিটে বাসা বেঁধেছে ছারপোকাও।’

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছি। কিছু দিনের মধ্যেই একটি রুটে পুরনো বাসগুলো দিয়েই একটি পাইলট প্রকল্প চালু হবে। সেখানে পুরনো বাসগুলো মেরামত করে রাস্তায় নামানো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোম্পানিভিত্তিক বাস চালু হলে এ রকম বাস আর থাকবে না। কিন্তু সেটা সময়ের ব্যাপার। বাস মালিকদের ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা, এসব বাস মেরামত করা এগুলোয় কিছুটা সময় লাগবে। সরকারেরও টার্মিনাল, ডিপো নির্মাণ করতে সময় লাগবে। আমরা এ উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতা করছি।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর