বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সংকটের শেষ নেই সরকারি হাসপাতালে

ছুটির দিনে বন্ধ থাকে বহির্বিভাগ-প্যাথলজি, হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি, চিকিৎসক ও নার্স কম, ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ জরুরি

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

সংকটের শেষ নেই সরকারি হাসপাতালে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সম্প্রতি চিকিৎসা নিতে আসা এক বৃদ্ধা মেঝেতে বসে পড়েন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রোগীর চাপ বেশি থাকলেও সংকটের শেষ নেই সরকারি হাসপাতালগুলোয়। চিকিৎসক-নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী সংকট প্রায় সব হাসপাতালেই। অধিকাংশ হাসপাতালেই আধুনিক মানের যন্ত্রপাতি নেই। কোথাও যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ান। সংশ্লিষ্ট জনবলের অভাবে বিকল হয়ে আছে অনেক অনেক যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া ছুটির দিনে বন্ধ থাকে বহির্বিভাগ ও প্যাথলজি। এতে ভোগান্তি বাড়ে রোগীর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগ দিনক্ষণ বুঝে হয় না। প্রতিদিনই নানা জটিল রোগী হাসপাতালে আসছেন। তাই ২৪ ঘণ্টা রোগীর সেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ জরুরি।

জানা যায়, শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সরকারি হাসপাতালের অধিকাংশেরই আউটডোর বা বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ছুটির দিনে সরকারি হাসপাতালগুলোয় জরুরি বিভাগ খোলা থাকলেও বহির্বিভাগে চিকিৎসক না থাকায় ছোট দুর্ঘটনা, জ্বর, মাথা ও পেটে ব্যথা, পেটে সমস্যা, বমি এবং সর্দি-কাশির মতো অসুখে ভুক্তভোগী রোগীদের চিকিৎসার জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি এবং ঈদের ছুটিতেও একইভাবে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় রোগীদের পড়তে হয় সমস্যায়।

সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে চিকিৎসকরা শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি উপভোগ করেন। কিন্তু যে পেশার সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যু জড়িত, সেখানে ছুটির দিনে রোগীদের সেবা প্রদানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি হাসপাতালের কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করে সীমিত পরিসরে বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা চালু করা যেতে পারে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী জানান, ছুটির দিনে বহির্বিভাগে চিকিৎসক বসেন না। এ জন্য রোগীদের, বিশেষ করে দরিদ্র রোগী, যাদের বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের সমস্যায় পড়তে হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, সারা দেশে কভিড-১৯ রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড আছে ৫৭৮টি। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বাকি বিভাগগুলোয় আইসিইউ বেড আছে ১৮১টি। এর অধিকাংশই বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। জেলা হাসপাতালে আইসিইউ বেড নেই।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চিকিৎসা একটি সেবা। স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই সেবা দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই এ পেশায় আসেন। এ জন্য কোনোভাবেই রোগীকে অবহেলা করা যাবে না। শুক্র-শনি নেই, হাসপাতালে সব দিনই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি জরুরি। নইলে কোনো রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারেন। এর দায় কে নেবে? আমি মনে করি, সরকারি হাসপাতালে এখনো জনবল অনেক কম। এটা কাটাতে হবে। সব চিকিৎসককেই অন্তত দুই বছর মাঠপর্যায়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কেউ সরকারি নির্দেশনা না মানলে নিতে হবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা।’ ঢাকা শহরের বাইরে ঢাকা বিভাগে আইসিইউ বেড সবচেয়ে বেশি। এ বিভাগে আইসিইউ বেড আছে ৪৭টি। তবে ঢাকার কাছের জেলা নরসিংদী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার হাসপাতালগুলোয় কভিড-১৯ রোগীদের জন্য কোনো আইসিইউ বেড নেই। আইসিইউর জন্য অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা অনেক বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে ঢাকার বাইরের, বিশেষ করে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, সাভার থেকে বেশি রোগী আসছে। চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ১০টি ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও ফরটিস প্রাইভেট হার্ট সেন্টারে ২৪টি। বিভাগের অন্য জেলাগুলোয় আইসিইউ নেই। বরিশালে ১৮টি ও সিলেটে ১৬টি আইসিইউ বেডের সব কটি বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোয়। অন্য জেলার হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ বেড নেই। রাজশাহী বিভাগের ২৮টি আইসিইউ বেডের ২১টি রাজশাহীতে ও সাতটি বগুড়া জেলায়। বাকি জেলাগুলোয় আইসিইউ নেই। খুলনা বিভাগে ১৮টি আইসিইউ বেড রয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায়। রংপুর বিভাগের ১৩টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রংপুরে ১০টি ও দিনাজপুরে রয়েছে তিনটি। এসব জেলায় জরুরি রোগীদের ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ফলে ঢাকার সরকারি ও অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছে।

সারা দেশের জরুরি রেফার্ড রোগীদের চাপ পড়ে ঢাকার বিশেষায়িত ও সাধারণ হাসপাতালগুলোয়। ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর ৫০ শতাংশই সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রেফার হয়ে আসা। নয় তো সেখানে সেবা না পেয়ে ঢাকার হাসপাতালে এসেছেন। কয়েক বছর ধরেই অসংক্রামক রোগের মধ্যে ক্যান্সারে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। কিন্তু জেলা সদরের হাসপাতালগুলোয় ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৩০০ শয্যায় এ রোগীর চাপ সামলানো অসম্ভব। হাসপাতালের আশপাশে বিভিন্ন ভবনের বারান্দায় সারা বছর থাকতে দেখা যায় ক্যান্সার রোগী ও স্বজনদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ক্যান্সার রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে বড় একটি অংশ দেশের বাইরে চিকিৎসা করায়। উচ্চবিত্তরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার জন্য যায়। মধ্যবিত্তরা যায় ভারতে। যাদের অন্য দেশে গিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই তারা রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় অসহায় পরিস্থিতিতে থাকে। খুলনায় পশুচিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন নিয়াজ হোসেন (২৮)। মোটরসাইকেল নিয়ে পাশের উপজেলায় যাওয়ার সময় হঠাৎ রাস্তার এক পাশ থেকে কুকুর দৌড় দিলে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। পায়ে আঘাত পেলে এক্স-রে করে দেখা যায় হাড় ভেঙে গেছে। প্লাস্টার করে বাড়ি ফেরার মাসখানেক পর পায়ে ইনফেকশন দেখা দেয়। চিকিৎসক দেখে বলেন, পা না কাটলে এ ঘা ওপরের দিকে উঠবে। এই রোগীকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতালে) রেফার করে দেন চিকিৎসক। করোনার এ পরিস্থিতিতে রোগী নিয়ে খুলনা থেকে ঢাকায় আসেন নিয়াজের স্বজনরা। ঢাকায় থাকার জায়গা না থাকায় বিপাকে পড়েন তারা। এরপর পঙ্গু হাসপাতালে তার অপারেশন সম্পন্ন হয়।

৫০ শয্যার পাবনার চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৩২টি। এর বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ১৫ জন। এ উপজেলার ৩ লাখের বেশি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। শুধু এ উপজেলা নয়, সারা দেশের চিকিৎসক, নার্স সংকটের চিত্র একই।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর হিসাব অনুযায়ী দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৭৫ হাজার চিকিৎসক ও ৩২ হাজারের মতো নার্স রয়েছেন। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ২ হাজার ২৬৭ জন মানুষের জন্য রয়েছেন একজন চিকিৎসক। এ ছাড়া ৫ হাজার ৩১৩ জন মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্বে রয়েছেন একজন নার্স।

আমাদের লাকসাম প্রতিনিধি ফারুক আল শারাহ জানান, কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলায় ১৬ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য। প্যাথলজি পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি থাকলেও নেই টেকনিশিয়ান। জরাজীর্ণ ভবনে চলছে একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র, একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও প্রায় ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম। ২০০৬ সালে উপজেলার জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নের গোহারুয়া গ্রামে ২০ শয্যা হাসপাতাল উদ্বোধনের ১৫ বছরেও পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা চালু হয়নি। বহির্বিভাগ চালু থাকলেও বরাদ্দ নেই কোনো ওষুধ।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকায় সাত-আট মাস ধরে সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ। নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব বলেন, উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা জনবল সংকট। কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবেই লোকবল নিয়োগ বন্ধ। এ কারণে এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।’

আমাদের নওগাঁ প্রতিনিধি বাবুল আখতার রানা জানান, নওগাঁয় সিভিল সার্জন কার্যালয়সহ মোট চিকিৎসকের ২৮১টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ১০৯টি। জেলার ৯৯টি ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে ৬০টি কেন্দ্রে থাকলেও বাকি ৩৯টি কেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। ২৮৭ জন নার্সের মধ্যে কর্মরত ২২৮ জন। এতে জেলার চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সাইদুল হক বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় অস্ত্রোপচার না হওয়ায় পুরো জেলার রোগীরা এখানে আসেন। বর্তমানে ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে চিকিৎসাসেবা চালানো হচ্ছে। এখানে আইসিইউ, ভেনটিলেটর, পিসিআর ল্যাবসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি নেই। এ ছাড়া নওগাঁ সদর হাসপাতালে ৪২ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত২৩ জন।’ নওগাঁর সিভিল সার্জন ডা. এ বি এম আবু হানিফ বলেন, ‘প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি মো. রফিকুল আলম জানান, ২৫০ শয্যার চাঁপাইনবাবগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ৪৬ জনের স্থলে কাজ চালাচ্ছেন ৩৬ জন চিকিৎসক। এর মধ্যে ১৪ জন স্থায়ী এবং ২২ জনকে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ডেপুটেশনে নিয়ে আসা হয়েছে। টেকনোলজিস্ট চারজনের জায়গায় রয়েছেন দুজন। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় এক বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. প্রধান মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, এ হাসপাতালে ৪৬ জনের মধ্যে ১০ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। তাই অল্পসংখ্যক চিকিৎসক দিয়ে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আমাদের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি শেখ রুহুল আমিন জানান, কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে ঝিনাইদহের স্বাস্থ্যসেবায় বেহাল চিত্রের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ আট বছর ধরে একই জনবল দিয়ে কাজ চলছে। ১০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য মাত্র ৪০ জন চিকিৎসক বরাদ্দ থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৩ জন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধিকাংশ যন্ত্রপাতি নষ্ট ও পুরনো। রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের সংকট। শৈলকুপা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. রাশেদ আল-মামুন অভিযোগ করেন, প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় কোনোরকমে চালাতে হচ্ছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। এ ছাড়া গাইনি চিকিৎসক না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে মেডিকেল অফিসার দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম বলেন, ‘স্বাভাবিক নিয়মেই হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ভুলত্রুটি থাকলে তা সমাধান করা হবে।’

আমাদের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি জহুরুল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে মাত্র ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যেখানে মাত্র সাতজন চিকিৎসক দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সেবা। দীর্ঘ সাত বছর ধরে অকেজো এক্স-রে মেশিন। দুটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে একটি সচল আরেকটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। দৌলতপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক থাকলে সব ধরনের রোগীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।’ আমাদের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জামান আখতার জানান, চরম জনবল সংকটে রয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল। হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হওয়ার ১৭ বছরেও পায়নি প্রয়োজনীয় জনবল। আগের ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই চলছে কার্যক্রম। ১০০ শয্যা অনুযায়ী ৪২ জন চিকিৎসকের বিপরীতে বর্তমানে ডেপুটেশনে আসা চার চিকিৎসকসহ কর্মরত মাত্র ২২ জন। এতে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে বর্তমানে ৫০ শয্যার বিপরীতেই মেডিসিন, ইএনটি, চর্ম ও যৌন, অ্যানেসথেসিয়া, চক্ষুসহ পাঁচজন কনসালট্যান্টের পদ খালি আছে। পূরণকৃত পদের মধ্যে চারজন ডেপুটেশনে এসে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা স্বপদে ফিরে গেলে চিকিৎসক সংকট আরও বাড়বে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ১৫০ শয্যার নতুন একটি বিভাগ খোলা হয়েছে। সেখানে নতুন করে ১০ জন চিকিৎসক যোগদান করেছেন। তবে এখানে অতিরিক্ত কোনো নার্স পাওয়া যায়নি। চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বারবার যোগাযোগ করেছি। তারাও একাধিকবার প্রয়োজনীয় জনবলের তথ্য সংগ্রহ করেছেন।’ আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি আবদুল বারী জানান, নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। এতে বেড়েছে তাদের ভোগান্তি। সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেক রোগী।

১৭ সেপ্টেম্বর নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের জনবল পদায়ন হলেও এখনো দেওয়া হয়নি নিয়োগ। এ ছাড়া পাঁচটি এক্স-রে মেশিনের তিনটি সচল রয়েছে। কোনো ইউনিট নেই ডেন্টাল বিভাগে। টেকনিশিয়ান পদে ১৩টির মধ্যে নয়টি পদই শূন্য। নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ মেজবাহুল হাসান চৌধুরী বলেন, জেনারেল হাসপাতালের জনবলের পদায়ন পাওয়া গেলেও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো থেকে চিকিৎসক ডেপুটেশনে এনে চালাতে হচ্ছে হাসপাতাল।

আমাদের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি সৈয়দ নোমান জানান, ফুলপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের ১০টি শূন্য রয়েছে। এমনকি সদর উপজেলায়ও ওই পদে দুজন থাকার কথা থাকলেও পূরণ হয়নি পদ। সব মিলিয়ে গোটা জেলার ১২ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৮৭ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু রয়েছেন মাত্র ১৪ জন। ৭৩টি পদই শূন্য।

১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর যন্ত্রপাতির হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে একটি চিঠি দেন সিভিল সার্জন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, অটোক্লেভ হাই প্রেসার স্টিম স্টেরিলাইজার, গাইনোকোলজি টেবিল, আলট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি মেশিন অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই বাক্সবন্দী। সিভিল সার্জন ডা. এ বি এম মশিউল আলম বলেন, ‘আমরা এসব সংকট উত্তরণে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এমনকি কয়েক দফা চিঠি দিয়েও ওপরমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।’

আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি সঞ্জয় কুমার দাস জানান, মির্জাগঞ্জ উপজেলা ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে রোগীদের সেবার নামে চলছে ফাঁকিবাজি। হাসপাতালের প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্টের পদ শূন্য। এক্স-রে মেশিনটি প্রায় দেড় যুগ ধরে ব্যবহারের অনুপযোগী অবস্থায় পড়ে আছে। এ জন্য যেতে হয় ক্লিনিকে। ব্যবস্থাপত্রে দেওয়া ওষুধের বেশির ভাগই বাইরের ফার্মেসি থেকে নিতে হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দিলরুবা ইয়াসমিন লিজা বলেন, উপজেলায় মোট ২১ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র ১০ জন। জুনিয়ার কনসালট্যান্ট সার্জারি, মেডিসিনসহ চারটি পদই শূন্য। প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্ট পদ শূন্য রয়েছে। আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি খায়রুল ইসলাম জানান, জনবল সংকটসহ নানা সমস্যার মধ্যেই চলছে গাজীপুরের সরকারি হাসপাতালগুলো। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় এ হাসপাতাল। হাসপাতালে মঞ্জুরিকৃত ৬১৬টি পদের মধ্যে পূরণ রয়েছে ৫৪০টি। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) হিসেবে কর্মরত আছেন আটজন। আরও কমপক্ষে ১২ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট প্রয়োজন।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. হাফিজ উদ্দিন জানান, হাসপাতালটিতে চিকিৎসক, টেকনোলজিস্টের স্বল্পতা থাকলেও নার্সের কমতি নেই। শিশু বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার, ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, অ্যানেসথেটিস্টের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান জানান, জেলার পাঁচটি উপজেলায় চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট পদে মঞ্জুরিকৃত জনবলের সংখ্যা ২২৮। তবে কর্মরত আছেন ২০৪ জন।

আমাদের নোয়াখালী প্রতিনিধি আকবর হোসেন সোহাগ জানান, নোয়াখালীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে রয়েছে চিকিৎসক, জনবল, যন্ত্রপাতি সংকট। তিন বছর ধরে ৫০ লাখ টাকা দামের এক্স-রে মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এর ওপর রয়েছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ও দালালদের উৎপাত। হাসপাতালের ভিতরে বর্জ্যরে পাহাড়, দুর্গন্ধ, জলাবদ্ধতা ও বিদ্যুৎ সংকটে রোগীদের অবস্থা নাকাল। ১৩টি পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর জেলা সভাপতি ডা. ফজলে এলাহী খান বলেন, ‘এ হাসপাতালে সমস্যার শেষ নেই। চিকিৎসকরা প্রাইভেট চেম্বারে ব্যস্ত দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক থাকেন না।’ তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুল আমিন বলেন, ‘আমি নতুন যোগদান করেছি। সব বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। কোনো অনিয়ম পেলে ছাড় দেওয়া হবে না।’

আমাদের শ্রীমঙ্গল প্রতিনিধি দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন জানান, সাত বছর ধরে নষ্ট এক্স-রে মেশিন। নেই এক্স-রে টেকনিশিয়ান। সনোলজিস্ট না থাকায় অকেজো পড়ে আছে আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন। টেকনিশিয়ান না থাকায় ইসিজি মেশিনটিও অকেজো। শূন্য রয়েছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালট্যান্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালট্যান্ট (মেডিসিন) ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেসথেসিয়া) পদ। বহির্বিভাগ-অন্তর্বিভাগে রয়েছে চিকিৎসক সংকট। পর্যাপ্ত জনবল নেই প্যাথলজি বিভাগে।

জানা যায়, ২০১২ সালে ৩১ শয্যার জনবল দিয়ে শুরু এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যায় কার্যক্রম চালু হয়। কিন্তু দীর্ঘ আট বছরেও ৫০ শয্যার জনবলের নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সংকটের মধ্যেও আমরা রোগীদের কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। জনবল চেয়ে সিভিল সার্জন অফিসে চিঠি পাঠিয়েছি।’

সর্বশেষ খবর