রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত চাওয়ায় অপমানিত হয়েছি

নিজস্ব প্রতিবেদক

আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত চাওয়ায় অপমানিত হয়েছি

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ

কারণ দর্শানো নোটিসে উল্লেখ করা ১১ অভিযোগ খন্ডন করে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জবাব পাঠিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ‘অসত্য’ দাবি করে সাবেক এই মন্ত্রীর দেওয়া জবাব দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন তিনি। গতকাল সকালে বনানীতে নিজ বাসভবনে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমি বিগত ২৯ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শোকজে আমার যোগদান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ, নামের বানানসহ অনেক ভুলই চিঠিতে দৃশ্যমান। দলের ভাইস চেয়ারম্যানকে একজন যুগ্মমহাসচিব (আদিষ্ট না হয়েও) এমন কঠিন আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত তলব করায় অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছি। এখানে প্রটোকল ও সৌজন্যের ব্যত্যয় ঘটেছে। ব্যক্তি রুহুল কবির রিজভীকে একজন ভদ্র, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী নেতা বলে জানি। তার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। তার কাছ থেকে এ ধরনের চিঠি আশা করিনি।

বাসার চার তলার ছাদে এ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছবি টানানো ছিল। সকাল ১০টায় পাঁচ পৃষ্ঠার জবাব তাঁর একান্ত সহকারী নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দিয়ে আসার পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন মেজর হাফিজ। এ সময় ভোলার লালমোহন ও তজুমদ্দিন উপজেলার শতাধিক নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তাঁর বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগের একটি একটি করে খন্ডন করেন বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান। বিভিন্ন সময়ে অর্পিত সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন না করা, শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে অসম্মান করে বক্তব্য দেওয়া, ওয়ান-ইলেভেনে মহাসচিব হওয়ার অভিযোগসহ নানা বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ খন্ডন করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমি একজন যুদ্ধাহত, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অসৌজন্যমূলক ভাষায়, অসত্য অভিযোগসংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস পেয়ে হতবাক হয়েছি। আমার বিনীত অনুরোধ, আমার বক্তব্য স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হোক। বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে যদি দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আমি যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছি। আমি দলীয় নেতৃত্বের প্রতি সব সময়ই শ্রদ্ধা পোষণ করি। হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, সামরিক বাহিনীর আমার অনেক বন্ধু, ব্যক্তিগত বন্ধুসহ অনেকেই আমাকে আজ পদত্যাগ করতে বলেছেন। আমি চিন্তাও করেছিলাম। কিন্তু আমার প্রিয় নেতা-কর্মীরা সেই আড়াই শ মাইল দূর থেকে লঞ্চে, নৌকায় নদী পার হয়ে এখানে এসে অনুরোধ করেছেন- আপনি পদত্যাগ করবেন না, অবসর নেবেন না। তাদের অনুরোধে আমি পদত্যাগ করলাম না। আমি দেখতে চাই, আমার এ ব্যাখ্যা তাদের (নেতাদের) কাছে সন্তোষজনক হয় কিনা। তারপর আমি পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব।

এ সময় বিএনপিকে বেশ কিছু পরামর্শও দেন মেজর হাফিজ। দলের এই প্রবীণ নেতা বলেন, বিএনপির একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করতে চাই। ক. ২০২১ সালের মার্চের মধ্যেই দলের জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করা হোক। খ. দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি বাণিজ্য এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে এসেছে। দলের স্থায়ী কমিটির একজন সিনিয়র সদস্যের নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করে কাউন্সিল সভার রিপোর্ট পেশ করা হোক। ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে দল থেকে একজনকে প্রার্থী এবং একজনকে বিকল্প প্রার্থীরূপে মনোনয়ন দেওয়া হোক। এতে মনোনয়ন বাণিজ্যের সুযোগ কমে যাবে। গ. দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি এবং অঙ্গসংগঠনের কমিটিসমূহ কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে গঠন করা হোক। সম্প্রতি আমার নির্বাচনী এলাকায় ছাত্রদলের কমিটি কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকায় বসে গঠন করেছেন, আহ্বায়ককেই আমি চিনি না! ছাত্রলীগের কর্মীরাও এ কমিটিতে স্থান পেয়েছে। আমার সুপারিশ বিবেচনা করা হয়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে কোনো উত্তর পাইনি। ২৯ বছর সার্ভিস দেওয়ার পর চিঠির একটি উত্তর আশা করতেই পারি। ঘ. দলের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হলে তদন্তের পর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। তা হলেই সত্য, নির্লোভ, মহান নেতা শহীদ জিয়াউর রহমানের আত্মা শান্তি পাবে। দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের চিন্তা করতে বলছি। দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি কেন আজ ক্ষমতার বাইরে, কারা এর জন্য দায়ী। ১৯৯৬ সালে লেজে-গোবরে হয়ে আমরা ইলেকশনে গিয়েছি। তার পরও ১১৬টি আসন পেয়েছি। প্রত্যেক মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন; আমরা এমপিরা বিজয়ী হয়েছি। সুতরাং চিন্তা করুন, মূক ও বধির না হয়ে চিন্তা করুন। দলের ভালোর জন্য কনট্রিবিউট করুন। দলকে সাজেশন দিন- কী করা উচিত। কেবল তোষামোদ করে দায়িত্ব শেষ করবেন না। জিয়াউর রহমানকে অনুসরণ করুন। তাঁর মতো সততার সঙ্গে রাজনীতি করুন। যদি অসৎ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিএনপি ব্যবস্থা নেয় মহান নেতা জিয়াউর রহমানের আত্মা কবরে শান্তি পাবে। মেজর হাফিজ বলেন, দেশে গণতন্ত্র আসুক, আমি চাই। গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য, মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য, জনগণের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য এবং এ অবৈধ সরকারকে বিদায় করার জন্য যে কোনো সংগ্রামে আমি সব সময় প্রস্তুত। যদি বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিশেষ করে ছাত্র-যুবকরা রাজপথে নামে কাল এ দলের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। তারা রাজপথে নামে না কেন অনেক চিন্তা করেছি। দলীয় নেতৃবৃন্দের উচিত এটা পর্যালোচনা করা যে, এত জনপ্রিয় দল বিএনপি ক্ষমতায় গেলে শতকরা ৮০টি ভোট পায়। কিন্তু রাস্তায় কেন ১০০ লোক নামে না। এটা চিন্তা করা উচিত। পাঁচ পৃষ্ঠার জবাবে রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে কোনো অসম্মানজনক, অসৌজন্যমূলক বক্তব্য রাখিনি। জিয়াউর রহমান সততা ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক। আমি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অধীন সেনা কর্মকর্তারূপে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি, সম্মুখসমরে আহত হয়েছি। ১৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দিনব্যাপী মরণপণ যুদ্ধের পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট শহর দখল করি। ২০২০ সালের এ দিনই আমার দল আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল! আমাকে নোটিস পাঠানোর আগে চিঠির বিষয়বস্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে আমার কর্মীরা মর্মাহত হয়েছেন। জবাবে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছি। বেগম খালেদা জিয়াকে অসম্মান করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। জিয়া পরিবারের কোনো সদস্যের প্রতি কখনই কটূক্তি করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। রাজনীতি ছেড়ে দিলেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শ হৃদয়ে লালন করব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর