সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ক্ষতি কাটাতে আরও এক বছর চান ব্যবসায়ীরা

মানিক মুনতাসির

করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দেশের অন্তত ৮৮ শতাংশ ব্যবসায়ী। তবে বাস্তব অর্থে ছোট-বড় এমন কোনো ব্যবসায়ী নেই, যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এতে বলা যায়, শতভাগ ব্যবসায়ীই ভুক্তভোগী। ক্ষতিগ্রস্ত এই ব্যবসায়ীরা আরও এক বছর সরকারি সুযোগ-সুবিধা চান। ব্যাংকঋণ পরিশোধ, সুদ ও অন্যান্য নীতিগত বিষয়ে আরও কিছু ছাড় চান সামনের বছরটা। চলতি বছরের প্রথম দিকে শুরু হওয়া এই মহামারীর ক্ষতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখনো। এ ছাড়া কবে নাগাদ সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।

তবে করোনা মোকাবিলায় সরকার যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, তা ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও সময়োপযোগী। ওইসব প্যাকেজ বাস্তবায়নে সরকার যে সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল তা চলতি মাসেই শেষ হতে যাচ্ছে। প্যাকেজ থেকে নেওয়া ঋণ সুবিধার অর্থ পরিশোধ করতে হবে জানুয়ারি থেকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কেননা একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বভাবিক হয়নি, অন্যদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে সারা বিশ্বেই। বাংলাদেশেও চলছে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক। প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও সংক্রমণের হার। এই প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নকাল এবং ঋণের অর্থ ফেরতের সময়সীমা আরও এক বছর বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে শতভাগ পুনরুদ্ধার করতে হলে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক গতি, যা এখনো ফিরে আসেনি। ফলে ব্যাংকঋণ ও প্রণোদনার ঋণ পরিশোধের সময়সীমা অন্তত জুন পর্যন্ত বাড়ানো উচিত বলে মত দিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকেই তা আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। জানা গেছে, মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের সব ধরনের শিল্প খাতে স্থবিরতা নেমে আসে বছরের শুরু থেকেই। এতে শিল্প খাতের সঙ্গে জড়িত অন্তত আড়াই কোটি মানুষ বিপর্যয়ের মুখে পড়েন। এদের মধ্যে অনেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ী তাদের প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক গতি ফেরাতে পারেননি এখনো। সাধারণ ছুটি চলাকালীন দেশের ছোট-বড় সব ধরনের কল-কারখানা বন্ধ ছিল। সে সময়ের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনেকেই। ফলে এসব শিল্পের বিপরীতে ব্যাংকে থাকা ঋণের সুদ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছিল। সেটা অন্তত আরও এক বছর বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে দাবি জানানো হয়েছে বিতরণ করা প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণের অর্থ ফেরত প্রক্রিয়া শুরুর সময়সীমা বাড়ানোর। অন্যথায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প খাত টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এমনিতেই করোনার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়েছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। জানা গেছে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শিল্প খাতের ভূমিকা অগ্রগণ্য। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে হাজার হাজার ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই আমদানির বিকল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোও দেশের অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এসব শিল্পের সঙ্গে দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। মহামারী রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের কারণে এদের সবার জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি সহায়তার ফলে শিল্পগুলোকে চালু রেখে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য কোনোরকমে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে এখনই এসব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা হলে আবারও নতুন করে অনিয়শ্চয়তা তৈরি হবে দেশের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে, যার একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই কর্মরত আছেন প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী। এর বাইরে কুটির, মাঝারি, বৃৃহৎ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, শিল্পমালিক, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজসহ এসব শিল্প খাতে মোট আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বিবিএসের ওই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সারা দেশে কুটির শিল্পের সংখ্যা ৬৮ লাখ ৪২ হাজার, ক্ষুদ্র্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১০ লাখের বেশি, ছোট শিল্প রয়েছে প্রায় ৯ লাখ, মাঝারি শিল্প রয়েছে ৭ হাজার, বৃহৎ শিল্প রয়েছে ৫ হাজার ২৫০টি। সব মিলিয়ে দেশে শিল্পের সংখ্যা ৭৮ লাখ ১৮ হাজারের বেশি। এসব শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অন্তত আড়াই কোটি মানুষ। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক ও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকারের সহায়তা আরও বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। জানা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারীর অভিঘাতে বিশ্বব্যাপীই অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা চলছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। বরং ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও বেশি। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো লকডাউন পরিস্থিতি চলছে। চলতি বছরের দুটি ঈদ, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখসহ কোনো উৎসবেই ন্যূনতম ব্যবসা করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। জুনের পর থেকে সব কিছু খোলা হলেও স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়নি শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য। এখনো বন্ধই রয়েছে স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বল্প পরিসরে খোলা হয়েছে পর্যটন অঞ্চল। বহির্বিশ্বেও রপ্তানির বাজারে ধস নেমেছে। বিদেশে কর্মী পাঠানো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কবে নাগাদ আবার তা চালু হবে কেউ জানে না। ফলে বছর শেষেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প ও বৈদেশিক শ্রমবাজার। ওয়ার্ল্ড এসএমই ফোরামের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৭৮ শিল্পের মধ্যে ৬০ লাখ ৮০ হাজারই কুটির শিল্প। এ ছাড়া ক্ষুদ্র শিল্প ১ লাখ ১০ হাজার, ছোট শিল্প ৮ লাখ ৫০ হাজার, মাঝারি শিল্প ৭১ হাজার আর বৃহৎ শিল্প রয়েছে ৫২ হাজার। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পঞ্চম স্থানে থাকা বাংলাদেশ এসএমই শিল্পসংখ্যায় বিশ্বে এখন সপ্তম স্থানে রয়েছে। এখন দেশে এসএমই খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ ৭৩ লাখ। এসব পরিসংখ্যান থেকে পরিষ্কার, দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে শিল্পের উদ্যোক্তারা এখন উল্টো পুঁজি হারানোর আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাত টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তার আওতা ও সময়সীমা বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর