সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অরক্ষিত রেললাইন, অবৈধ রেল গেটের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা

জয়পুরহাটে ট্রেন বাস দুর্ঘটনায় গেটম্যান বরখাস্ত

শামীম আহমেদ

রেল দুর্ঘটনা কমানোসহ রেলসেবার মান বাড়াতে প্রতি বছর নেওয়া হচ্ছে হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। রেললাইনে চলাচল করলে রয়েছে গ্রেফতার করার আইন। তবুও থামছে না রেলপথে মৃত্যু। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন হয়। প্রতিবেদন তৈরি হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা কমাতে নেওয়া হয় না কার্যকর ব্যবস্থা। চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনেই রেল দুর্ঘটনায় দেড় ডজনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় দুই মাস বন্ধ থাকার পরও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে রেলপথে ১০৫টি দুর্ঘটনায় ২৬ নারী ও ১১ শিশুসহ অন্তত ১১৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন।

গত শনিবার সকালে জয়পুরহাট সদরের পুরানাপৈল রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষে ১২ জন নিহত হন। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়ায় রেলক্রসিংটির দায়িত্বে থাকা গেটম্যান নয়ন মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, দুর্ঘটনার সময় রেলক্রসিংটির গেট খোলা ছিল এবং গেটম্যান ঘুমিয়ে ছিলেন। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই দিনে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় দ্বীন ইসলাম (১৬) নামে এক কিশোরের। পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার সময় ওই কিশোর রেললাইনে বসে ইয়ারফোনে গান শুনছিল। গত ৮ ডিসেম্বর বগুড়ার সান্তাহার জংশন স্টেশনের রেলগেট এলাকায় অল্পের জন্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় দিনাজপুরগামী আন্তনগর দোলনচাঁপা এক্সপ্রেস। ট্রেনটি রেলগেটের কাছাকাছি আসার সময় গেট খোলা পেয়ে প্রায় অর্ধশত যানবাহন রেলগেট চত্বরে ঢুকে পড়ে। রেললাইনে উঠে পড়ে একটি ট্রাক। ট্রাকটি লাইন থেকে সরে যাওয়ামাত্র ট্রেনটি ওই স্থান দিয়ে পার হয়ে যায়। অল্পের জন্য রক্ষা পায় ট্রেন ও ট্রাক। ঘটনার সময় রেলগেটের দুই পাশে থাকা দুই গেটম্যানের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। ৪ ডিসেম্বর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জে একই ট্রেনে কাটা পড়ে রহিদুল ইসলাম ইমরান (২৫) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহীসহ দুজনের মৃত্যু হয়। ওইদিনই নরসিংদীর রায়পুরায় রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে এগারোসিন্ধুর ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান নজরুল ইসলাম (৬০)। রেলওয়ে সূত্র জানায়, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৮৯ শতাংশই ঘটছে অরক্ষিত ক্রসিংয়ের কারণে। সারা দেশে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথে লেভেলক্রসিং রয়েছে দুই হাজার ৫৪১টি। যার মধ্যে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ ও অননুমোদিত ক্রসিং ১ হাজার ১৪১টি। গেটম্যান আছে মাত্র ৪৬৬টিতে। বাকি ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান না থাকায় এসব স্থান মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। আবার অনেক স্থানে গেটম্যান থাকার পরও তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া দুর্ঘটনার বড় একটা অংশই ঘটছে অরক্ষিত রেলপথ দিয়ে চলাচল, বাজার বসানোর কারণে। রেললাইনের পাশে অবৈধ স্থাপনার কারণে ট্রেন না দেখা, রেললাইনে প্রস্রাব করতে যাওয়া, কানে হেডফোন লাগিয়ে বা মোবাইলে কথা বলতে বলতে রেললাইনে হাঁটতে গিয়েও অনেক মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের আগের তিন বছরে কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় ৪৩০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে রেললাইন থেকে। রেলপথ পুলিশের তথ্যমতে, ঢাকার রেললাইনে মোট মৃত্যুর পাঁচ শতাংশ আত্মহত্যা বলে তদন্তে পাওয়া গেছে। ১০ শতাংশ অসুস্থতাজনিত কারণে মারা যান। প্রায় ৮০ শতাংশ মৃত্যুই ঘটছে অসতর্কতার কারণে। বাকি ৫ শতাংশ হত্যা ও অন্যান্য কারণে মৃত্যু। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, আইন অনুযায়ী রেললাইন ছাড়াও লাইনের দুই পাশে মোট ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ এমনকি গবাদিপশুরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার মধ্যে কাউকে পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করা যায়। তবে, রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মগবাজার, তেজগাঁও, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ের দুই পাশে সব সময় কয়েকশ মানুষকে  রেললাইন ধরে হাঁটতে দেখা যায়। নিয়মিত বাজার বসছে রেললাইনের ওপর। দুই পাশজুড়ে রয়েছে অসংখ্য দোকান, স্থাপনা ও ছাপরা ঘর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০ বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকায় শতাধিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে রেলের উন্নয়নে। অর্ধেক প্রকল্পই শেষ হয়েছে। কিন্তু নিরাপদ হয়নি রেলপথ। বাড়েনি সেবার মান। ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেললাইনের দুই পাশে ১০ ফুটের মধ্যে চলাচলে বিশ্বের সব দেশেই বিধিনিষেধ আছে এবং সেটা কঠোরভাবে মানা হয়। এখানে রেললাইন ঘেঁষেই বস্তি, বাজার। সবাই চলাচল করছে। রেললাইনে মানুষের চলাচল বন্ধ করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যেত। এ ছাড়া দুর্ঘটনার বড় অংশ ঘটছে ঢাকায় ও লেভেল ক্রসিংয়ে। ক্রসিংয়ে দায়িত্বরতদের অবহেলায় অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটছে। ক্রসিংয়ে সারাদিন মানুষ দাঁড় করিয়ে না রেখে কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে সহজেই এসব দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। চীনে প্রচুর ট্রেন চলছে এই ব্যবস্থায়। এরপরও ঢাকার বাইরে যেসব স্থানে সেটা করা সময়সাপেক্ষ হবে, সেখানে কর্মী বাড়িয়ে শিফট অনুযায়ী ডিউটি দিতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একজন বৃদ্ধকে ১২ ঘণ্টা বসিয়ে রাখলে সে তো ঘুমাবেই। এ ছাড়া আমাদের একটা প্রস্তাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোয় আন্ডারপাস করে দেওয়া। এ ছাড়া আনিসুল হক মেয়র থাকাকালীন নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেললাইন আন্ডারগ্রাউন্ড করার একটা প্রস্তাব ছিল। এটা করতে পারলে ওপর দিয়ে ১২ লেনের সড়কও করা সম্ভব। তার ওপর দিয়ে মেট্রো রেল নেওয়া সম্ভব। বর্তমান দুই মেয়র খুবই ইতিবাচক মানসিকতার। তাদেরকে সহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে রেল মন্ত্রণালয় বসতে পারে। সবাই মিলে বসে নিরাপদ ও সুন্দর রেল ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব নয়।

জয়পুরহাটে ট্রেন বাস দুর্ঘটনায় গেটম্যান বরখাস্ত : জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেটে বাস-ট্রেন দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহতের ঘটনায় গেটম্যান নয়নকে বরখাস্ত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগ। জয়পুরহাটের স্টেশন মাস্টার বরখাস্তের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এদিকে নিহত ১২ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রাশেদ মোবারক জুয়েল। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি তদন্তের কাজ শুরু করেছে। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেজা হাসান। এ দুর্ঘটনায় জিআরপি সান্তাহার থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর