বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা সিআইডির

দুদকের মামলায় স্ত্রী-মেয়েকে ২৮ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের নির্দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা সিআইডির

লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৭ টাকা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ২০১৬ থেকে এই মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও টাকা পাচারের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামকে আগামী ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। গতকাল রাজধানীর পল্টন থানায় পাপুলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আল আমিন হোসেন। এ মামলায় পাপুলের ব্যক্তিগত কর্মচারী সাদিকুর রহমান মনির, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম এবং ভাই কাজী বদরুল আলম লিটনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া লিটনের ম্যানেজার গোলাম মোস্তফাসহ আরও দুটি প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো- জেসমিনের জে. ডব্লিউ লীলাবালী  এবং লিটনের জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল। সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, পাপুল সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের মাধ্যমে প্রচুর অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। গত জুনে অবৈধ মুদ্রা ও মানব পাচারের অভিযোগে পাপুলের ‘মারাফিয়া কুয়েতিয়া’ প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ ঘোষণা করে কুয়েত। একইসঙ্গে ১১ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। এরা কুয়েত যেতে ‘জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল’ এ ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে দেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে আবদুল আলীম গত ৭ জুলাই পাপুল ও তার কর্মচারী মনিরের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মানব পাচারের অভিযোগে একটি মামলা করেন। পাপুল তার ব্যক্তিগত কর্মচারী মনিরের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কুয়েত যেতে ইচ্ছুক বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছে সিআইডি। প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া মোট ৩৮ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৭ টাকা রূপালী ব্যাংকের রাজারবাগ শাখায় মনিরের ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে জমা করা হয়। পরে পাপুল, তার শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং উত্তোলন করা হয়েছে। জেসমিন প্রধানের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের হাতিরপুল শাখায় থাকা হিসাব নম্বরে বিভিন্ন সময়ে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং চেকের মাধ্যমে আরও ৮ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়াও জেসমিন প্রধানের জে. ডব্লিউ লীলাবালী নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে আরও ৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। মনিরের ব্যাংকের হিসাব থেকে জেসমিন প্রধান ও তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে মোট ১৭ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু জেসমিন প্রধানের সঙ্গে মনিরের কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। আবার মনিরের ব্যাংক হিসাব থেকে পাপুলের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের গুলশান শাখায় থাকা ব্যাংক হিসাবে দুই ধাপে ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। পাপুলের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফোর পয়েন্ট হাউজিং ও রিয়েল এস্টেটের ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়। এক্ষেত্রেও পাপুল আর মনিরের মধ্যে লেনদেন সংক্রান্ত কোনো ব্যবসা বা কোনো বৈধ ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়নি। মনিরের ব্যাংক হিসাব থেকে গত বছরের ২ এপ্রিল পাপুলের মেয়ে ওয়াফা ইসলামের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের হাতিরপুল শাখায় থাকা ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ এবং গত ৫ জানুয়ারি ওয়াফার মালিকানাধীন সাফা জেনারেল নামে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৫ লাখ টাকাসহ মোট ১৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়।

অনুসন্ধানে সিআইডি জানতে পারে, পাপুলের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মোট পরিমাণ ৪১ কোটি ৭ লাখ ১৬ হাজার ১২২ টাকা। তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামের সম্পদের পরিমাণ ৬৪ কোটি ৫১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮২ টাকা। মানব পাচারের অপরাধলব্ধ আয় সরাসরি সেলিনা ইসলামের হিসাবে স্থানান্তরিত হওয়ার তথ্য এখনো পায়নি সংস্থাটি। তবে তদন্তকালে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এদিকে পাপুলের মেয়ে ওয়াফা ইসলামের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের মোট পরিমাণ ৭ কোটি ৭৭ লাখ ৭৪ হাজার ৩৪৪ টাকা। শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৩০ লাখ ১০ হাজার টাকা।

সিআইডির অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেসমিন ও প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সাউথইস্ট ব্যাংকে মোট ৩৮টি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেছেন। এতে মোট ১৬৪ কোটি ৯১ লাখ ৯৮ হাজার ৭০২.৪০ টাকা জমা হয়েছে। উত্তোলন করা হয়েছে মোট ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৪.৪৭ টাকা। স্থিতি আছে ২৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪২.০৫ টাকা। পাপুল, তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও ব্যক্তিগত কর্মচারী মনিরের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের শুরু থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত সর্বমোট ৩৫৫ কোটি ৮৬ লাখ ২৯ হাজার ৬৭০.০৬ টাকা জমার তথ্য পাওয়া যায়। হিসাবগুলোতে বর্তমানে স্থিতি ১ কোটি ৩০ লাখ ১৯ হাজার ৭০৩.৬০ টাকা। 

পাপুলের স্ত্রী-কন্যাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ : পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলামকে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। গতকাল বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন মো. খুরশীদ আলম খান। জামিন আবেদনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার ও আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।

গত ১১ নভেম্বর দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ ও ১৪৮ কোটি টাকার অর্থ পাচারের অভিযোগে পাপুল, তার স্ত্রী সেলিনা, মেয়ে ওয়াফা ও শ্যালিকা জেসমিনসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ২৬ নভেম্বর সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলাম হাই কোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলেন। অন্যদিকে অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতের কারাগারে আছেন এমপি পাপুল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর