সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

এমপি পাপুল পরিবারের ৬১৭ ব্যাংক হিসাব জব্দ জামিন স্ত্রী-কন্যার

আদালত প্রতিবেদক

এমপি পাপুল পরিবারের ৬১৭ ব্যাংক হিসাব জব্দ জামিন স্ত্রী-কন্যার

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের মামলায় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবং মেয়ে ওয়াফাকে জামিন দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ আসামিদের জামিনে মুক্তির এ আদেশ দেন। আসামিরা গতকাল বিকালে আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আইনজীবীরা জামিন আবেদন করেন। শুনানি শেষে তাদের জামিন দেন বিচারক। এর আগে এই দুই আসামি উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করেছিলেন। উচ্চ আদালত তাদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিল।

এদিকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের পৃথক দুই মামলায় এমপি পাপুলসহ ছয়জনের ৬৭০টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। দুদক ও সিআইডির পৃথক দুটি আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ এ আদেশ দেন। এর মধ্যে পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামের ব্যাংক হিসাবই রয়েছে ৬১৭টি।

গতকাল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের পর আসামি পক্ষের আইনজীবী প্রাণনাথ সাংবাদিকদের জানান, আসামিদের নামে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। এ ছাড়া আসামি সেলিনা সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। তার মেয়ে ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন। পাপুল ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দসহ পাপুলদের ৯২টি তফসিলভুক্ত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করারও নির্দেশ দিয়েছে একই আদালত। এ ছাড়া পল্টন থানায় সিআইডির করা অর্থ পাচার মামলাতেও পাপুল, তার প্রতিষ্ঠানসহ আটজনের ৫৩টি হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দেন বিচারক।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন লক্ষ্মীপুর-২ আসনে। পাপুল অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হওয়ার পর ১১ নভেম্বর তার এবং তার স্ত্রী, শ্যালিকা ও মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এর উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারে সহযোগিতা করায় পাপুল-সেলিনার মেয়ে ওয়াফা ইসলামকেও আসামি করা হয়েছে।

মামলায় অভিযোগে বলা হয়, পাপুল-সেলিনা দম্পতি ২ কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। এ ছাড়া ‘কাগুজে প্রতিষ্ঠানের’ আড়ালে জেসমিন প্রধান পাঁচ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০১২ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে পাচার করেছেন ১৪৮ কোটি টাকা। মামলায় জেসমিনের বিষয়ে বলা হয়, তিনি শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় বোন সেলিনা ইসলাম ও দুলাভাই পাপুলের অবৈধ অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিং করে বৈধতায় রূপ দিতে ‘লীলাবালি’ নামের একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিভিন্ন ব্যাংকে তার নামে ৪৪টি ব্যাংক হিসাব খোলেন, যেখানে শুধু এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেই রয়েছে ৩৪টি এফডিআর হিসাব। আসামি পাপুল এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন, বিধায় এ সুবিধা গ্রহণ করতে তার কোনো বেগ পেতে হয়নি। এর আগে ১৭ জুন পাপুলের স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক। পাশাপাশি পাপুল দেশে ফিরলে আর যেন বিদেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে এসবিতে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমনের এ সংস্থাটি। জনশক্তি রপ্তানিকারক পাপুলকে ৬ জুন কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে দেশটির পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মানব ও অর্থ পাচার এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ এনেছে কুয়েতি প্রসিকিউশন।

পাপুল ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচিত হন লক্ষ্মীপুরে। ওই নির্বাচনে আসনটি আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ মুহূর্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ালে বিএনপিকে ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ পাপুলের পক্ষে কাজ করেছিল। পাপুল নিজে এমপি হওয়ার পর স্বতন্ত্র এমপি কোটায় পাওয়া সংরক্ষিত একটি আসনে তার স্ত্রী সেলিনাকে এমপি করে আনেন।

ব্যাংক হিসাব জব্দ : আসামি এমপি পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামের ৬১৭টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন। একই সঙ্গে গুলশানে পাপুলের দুটি ফ্ল্যাটসহ ৯২টি সম্পদ জব্দের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। শুনানি নিয়ে আদালত ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দের আদেশ দেন।

এ ছাড়া পল্টন থানার অর্থ পাচার মামলায় এমপি পাপুলসহ ছয়জনের ৫৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেন সিআইডির অতিরিক্ত এসপি মো. ইকবাল হোসেন। আদালত শুনানি নিয়ে এসব ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়।

আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে সিআইডি উল্লেখ করে, আসামি পাপুলসহ ছয়জনের ৫৩টি ব্যাংক হিসাবে (এফডিআরসহ) মোট ৩৫৫ কোটি ৮৬ লাখ ২৯ হাজার ৬৭০ টাকা পাওয়া গেছে। এসব টাকার প্রধান উৎস মানব পাচারের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ আয় বলে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়। আসামির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সঙ্গে অপরাধলব্ধ আয়ের যোগসূত্র নির্ণয়ের কাজ চলমান রয়েছে।

এর আগে ২২ ডিসেম্বর এমপি পাপুলসহ ছয়জনের নামে মামলা করে সিআইডি। মামলায় বলা হয়, মানব পাচার করে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫-৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন আসামিরা। গত চার বছরে তিনি ও তার সহযোগীরা দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কুয়েতে মানব পাচার করে সোয়া ৩৮ কোটি টাকা আয় এবং পাচার করেছেন। মামলায় এমপি পাপুলসহ ছয়জন এবং তার স্বজনদের দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়। এজাহারভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- পাপুলের মেয়ে ওয়াফা ইসলাম, ভাই কাজী বদরুল আলম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান, ব্যক্তিগত কর্মচারী মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান, জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা। এ ছাড়া জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল (মালিক বদরুল আলম) এবং জে ডব্লিউ লীলাবালি প্রতিষ্ঠানকেও (মালিক জেসমিন প্রধান) আসামির তালিকায় রাখা হয়।

সর্বশেষ খবর