মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ভোজ্য তেলের দামে টালমাটাল বিশ্ববাজার

সিঅ্যান্ডএফ মূল্য ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, করোনার কারণে সরবরাহ কম, ট্যাক্স কমানোর দাবি পরিশোধনকারীদের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে আর্জেন্টিনায় প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন তেলের (সিঅ্যান্ডএফ) আমদানিমূল্য ছিল ১ হাজার ১৩৪ ডলার। আর ইন্দোনেশিয়ায় খোলা পাম তেলের আমদানিমূল্য বেড়ে ৯৯০ মার্কিন ডলারে ওঠে। বিশ্ববাজারে আমদানিমূল্য বাড়ার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত সপ্তাহের আমদানিমূল্যের সঙ্গে সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স, পরিশোধন ও বিপণন খরচ যোগ করলে বর্তমানে প্রতি লিটার সয়াবিন বোতলজাতকরণ পর্যন্ত খরচ পড়ে ১৩২ টাকা। অথচ খুচরা পর্যায়ে এখন কোম্পানিভেদে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম রাখা হচ্ছে গড়ে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা, আর ৫ লিটারের বোতলের দাম পড়ছে ৬২৫ টাকা। পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, বাজারে এখন যে দামে ভোজ্য তেল (সয়াবিন ও পাম) বিক্রি হচ্ছে, গত সপ্তাহের আমদানিমূল্য ধরে বিক্রি করলে খুচরা মূল্য আরও বেশি হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারের এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোয় ভোজ্য তেলের দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা পরিশোধনকারীদের। সংশ্লিষ্টরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারের ঊর্ধ্বমুখী ধারা বিবেচনা করে সম্প্রতি প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করার জন্য ট্যারিফ কমিশনকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু ওই চিঠির পর আন্তর্জাতিক বাজারে আরও কয়েক দফা বেড়েছে পণ্যটির দাম। বিষয়টি নিশ্চিত করে অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও টি কে গ্রুপের গ্রুপ ডিরেক্টর মোস্তফা হায়দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আমরা সয়াবিনের দাম বাড়ানোর জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। এখনো ট্যারিফ কমিশন আমদানি-কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। এ দুই সপ্তাহে সয়াবিনের আন্তর্জাতিক বাজার দর আরও বেড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ভোজ্য তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যেভাবে বাড়ছে সে অনুযায়ী সরকার মূল্য সমন্বয় না করলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না।’

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার কারণ : আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার পেছনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি- ১. কভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় এবার ১১ থেকে প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে; ২. বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভোজ্য তেল ব্যবহারকারী চীন পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আগেভাগেই প্রায় ৬০ শতাংশ ভোজ্য তেল অগ্রিম বুকড করে ফেলেছে এবং ৩. সর্বশেষ ১০ দিন ধরে আর্জেন্টিনায় সয়াবিন ক্র্যাশারদের পাশাপাশি পোর্টে স্ট্রাইক চলমান থাকায় সরবরাহ খাতে মারাত্মক চাপ পড়েছে। আর এসব কারণেই গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে ভোজ্য তেলের দাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সাত মাস ধরে বিশ্ববাজারে ধীরে ধীরে দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এর সঙ্গে আর্জেন্টিনার স্ট্রাইক পণ্যটির দামে আরও বেশি প্রভাব ফেলেছে। সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ সয়াবিন বিক্রেতা দেশ দুটি হলো আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। ওই দুটি দেশে করোনা পরিস্থিতি এত বেশি খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে যা সয়াবিনের সরবরাহ-ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী চাহিদার তুলনায় পণ্যটির সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম হুহু করে বাড়ছে।’

তিন পর্যায়ে ভ্যাট-ট্যাক্স মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা : ভোজ্য তেলের এ উচ্চমূল্যের ওপর তিন পর্যায়ে করারোপের কারণে পণ্যটির দাম আরও বেশি পড়ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। করারোপ বেশি হওয়ায় সাধারণ ভোক্তাদের কাছে চাইলেও কম মূল্যে পণ্যটি সরবরাহ করা সম্ভব হয় না বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি- বর্তমানে সয়াবিনের যে দাম সে দামে কেউ পণ্যটি নিতে চাইছে না।

পরিশোধনকারীরা বলছেন, বর্তমানে ভোজ্য তেল আমদানিতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কাটা হচ্ছে। এর সঙ্গে ৪ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) ও ডিএফ ভ্যাট নামে আরেক ধরনের কর দিতে হয়। এর সঙ্গে ৬ থেকে ৯ শতাংশ হারে ব্যাংক সুদ, রিভারডিউস, সার্ভে কস্ট এবং লাইটারিং/পরিবহন খরচ হয় আরও প্রায় ৩ শতাংশ। এরপর পরিশোধন ও বিপণন খরচ মিলিয়ে প্রতি লিটার ভোজ্য তেলের সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যয় যুক্ত হয় অন্তত ২৬ টাকা।

একটি পরিশোধনকারী কোম্পানির প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত সপ্তাহের আন্তর্জাতিক বাজার অনুসারে চট্টগ্রামে প্রতি টন সয়াবিনের দাম ছিল (সিঅ্যান্ডএফ) ১ হাজার ১৩৪ ডলার। লিটারপ্রতি ভ্যাট-ট্যাক্সসহ যার আমদানি খরচ ১০৬ টাকা। এর সঙ্গে পরিশোধন, ব্যাংক সুদ ও অন্যান্য খরচ হিসাবে ২৬ টাকা যোগ করে প্রতি লিটার সয়াবিন বোতলজাত করতেই খরচ হয় ১৩২ টাকা। এর পর মিলগেট থেকে পাইকারি বাজার হয়ে খুচরা পর্যায়ে এর দাম আরও বেশি হবে।

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা হায়দার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সরকারের নেই। সরকার যা পারে তা হলো ভ্যাট-ট্যাক্স কমিয়ে ভোজ্য তেলের বাজারজাতকরণ খরচ কমাতে সহায়তা করা।’ তিনি বলেন, ‘পরিশোধনকারীদের মধ্যে দুই ধরনের সুপারিশ রয়েছে। এক পক্ষ চাইছে আমদানির ওপর একটি ফিক্সড ট্যাক্স আরোপ হোক। আরেক পক্ষ যেভাবে আছে তা বহাল রেখে মোট আমদানিমূল্যের ওপর শতাংশ হারে করারোপের দাবি জানিয়েছে। এখন যেটাই হোক সরকার এটি কোন পদ্ধতিতে করবে তা তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা মনে করি ভোজ্য তেলের ওপর কর কমালে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের চাপ থেকে ভোক্তাসাধারণ রেহাই পাবে।’

সর্বশেষ খবর