বৃহস্পতিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ক্ষমতার বাইরে ১৪ বছরে বিএনপি

নেতারা বলছেন, ৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৩৭ লাখ মামলা । খালেদা-তারেকের নির্বাচনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত । দলে চেইন অব কমান্ডের ঘাটতি । স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে মিত্র করায় ভাবমূর্তি সংকট । খালেদার মুক্তি আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

মাহমুদ আজহার

ক্ষমতার বাইরে ১৪ বছরে বিএনপি

ক্ষমতার বাইরে থাকার ১৪ বছরের বেশি সময় অতিক্রম করেছে বিএনপি। বিদায়ী বছরের অক্টোবরে ক্ষমতা ছাড়ার ১৪ বছর পূর্ণ হয়। দীর্ঘ এই সময়ে ক্ষমতার বাইরে থাকা এ দলটি এখন নানা ভুলভ্রান্তির বেড়াজালে। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও আছে বিচ্ছিন্নতা। বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগেও পিছিয়ে দলটি। প্রায় তিন বছর ধরে দলের প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী। সরকারি নির্বাহী আদেশে তিনি এখন গুলশানে নিজ বাসায় অবস্থান করলেও দল-নেতা-কর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত। বিএনপির ‘চেইন অব কমান্ডের’ যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যদিও বিএনপি তা অস্বীকার করে বলছে, দলের নেতৃত্বে কোনো সমস্যা নেই। এই সময়ে বিএনপির ৫ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৩৭ লাখ মামলা হয়েছে। বেগম জিয়া, তারেক রহমান থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরাও আছেন আসামির তালিকায়। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বার্ধক্য ও সাজাপ্রাপ্ত আসামিসহ নানা আইনি জটিলতায় বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ও নির্বাচনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারেক রহমানও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তসহ বিভিন্ন মেয়াদে আসামি হওয়ায় তার নির্বাচনী ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ৮৬ মামলার আসামি হয়ে প্রায় প্রতিদিনই আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। দলের স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একই অবস্থা। দীর্ঘ ১৪ বছরেও দল শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। মূল দল বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলো এখনো অগোছালো। এ অবস্থায় কোন পথে হাঁটবে বিএনপি এর কোনো স্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা দিশাহারা ও দিগ্্ভ্রান্ত। তাদের আশার আলো দেখানোরও সক্ষমতা হারিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

এদিকে স্বাধীনতাবিরোধীদের মিত্র করার ট্যাগ মুছতে পারেনি বিএনপি। যদিও দলটিতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কম নয়। দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এখন দলটির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। জন্মকালে ঠেকায় পড়ে শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেছিল বিএনপি। সেই যে ট্যাগ লাগল স্বাধীনতাবিরোধীদের মিত্র করার, এরপর আর কখনই দলটি এই ইমেজ ভাঙার চেষ্টা করেনি। এত কিছুর পরও তারা ভুলের রাজনীতিতে খাবি খাচ্ছে। জামায়াত সঙ্গ ত্যাগ করতে পারছে না তারা। যদিও দলটি বলছে, জামায়াতের সঙ্গে তাদের আদর্শগত সম্পর্ক নেই। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে ভুগছে। ১৯৯১ সালের সংসদে তারা ইনডেমনিটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরে এসেছে। জিয়াউর রহমান দন্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেননি। অথচ এই অপবাদ তাকে নিতে হয়েছে। বিএনপির নেতারা কখনো বিষয়টি পরিষ্কার করেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির রাজনৈতিক সমস্যা দলের ভিতরই। এটা এখনো তারা সমাধান করতে পারেনি। দলটি এখনো পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি থেকে বেরোতে পারেনি। দলের ভিতর নেই গণতন্ত্র। নেতৃত্ব সংকটও আছে। বিএনপি আরেকটি ক্ষেত্রে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। তা হলো স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে মিত্র করা। এটা দেশি-বিদেশি মহলসহ এ দেশের তরুণ প্রজন্ম পছন্দ করে না। এই সংকট বিএনপিকে পিছিয়ে দিয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, বিরোধী দলের দায়িত্ব থাকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার। সেই জায়গায়ও বিএনপির একটি ঘাটতি রয়েছে। তারা সরকারি দলের শুধুই সমালোচনা করছে। কিন্তু নিজেরা কী করবে, তাদের ভিশন কী তাও স্পষ্ট নয়। এ কারণে জনগণও বিএনপির পক্ষে থাকার ব্যাপারে উৎসাহী নয়।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, ‘বিএনপি এখন বড় সংকটে আছে। ওয়ান-ইলেভেনেই বিএনপি ভেঙে যায়। এরপর থেকেই সংকট পিছু ছাড়ছে না দলটির। এরপর আওয়ামী লীগ সরকারে এসে বিএনপিকে মামলায় কাবু করে ফেলে। দলের প্রধান এখন আটক। দ্বিতীয় প্রধান সরকারের ভাষায় পলাতক, এখন লন্ডনে নির্বাসিত। বিএনপি এখন হচ্ছে হালবিহীন নৌকার মতো। এখন দলে কোনো নেতৃত্ব নেই। যারা আছেন, তাদের মধ্যে নানা মত, কোন্দল প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। কিছুদিন আগেও মেজর হাফিজের সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ পায়। দল হিসেবে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা এখন আর নেই। এ অবস্থায় এক যুগ ধরে আন্দোলনের কথা বলছে দলটি। আমাদের দেশের ইতিহাসে নেই, আন্দোলন করে সরকারের রাজপথে পতন হবে। চাপ দিয়ে ভোট আদায় করা যায়, যা ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছিল। নব্বইয়ে নানা সমীকরণ ছিল। এখন সরকারের ওপর এমন কোনো চাপ নেই যে তারা একটি নির্বাচন দেবে। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই বিএনপি সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। ২০০৮ সালের পর থেকে এটা প্রমাণ হয়েছে।’

অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপিতে নেতৃত্বশূন্যতা নেই। দল আগের যে কোনো সময়ের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিয়েই দল পরিচালনা করছেন। নানা প্রতিকূল পরিবেশেও বিএনপি এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে এই সরকারের ভরাডুবি হবে। আমরা গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে আছি। সফল হলেই আমরা ঘরে ফিরব।’

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, দলের শীর্ষ নেতৃত্বে সন্দেহ-অবিশ্বাস এখন চরমে। দলের বড় একটি অংশকেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। গুটিকয় নেতাই দল চালাচ্ছেন। কমিটি গঠন বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেন দু-চারজনই। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে বিএনপির নির্বাহী কমিটি অনেকটাই অকার্যকর। দলের তরুণ ও প্রবীণ নেতৃত্বের সংকটও চলছে। এটা কাটাতে না পারলে বিএনপি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবেও ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

এদিকে দলের সিনিয়র নেতাদের বড় একটি অংশই তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যোগসাজশ করছে বলে বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে অভিযোগ এসেছে। তারা সরকার পতনের আন্দোলনের নামে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে ‘মাইনাস’ করতে চায় বলেও অভিযোগ। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা ভিন্ন কোনো প্রক্রিয়ায় সরকারের পতন চায় না। এ ক্ষেত্রে জোট ও ফ্রন্টের শরিক দলের নেতারাও রয়েছেন বলে বিএনপির হাইকমান্ড মনে করে। সম্প্রতি দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয়। পরবর্তী সময়ে একজনকে দলের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে ফেরত নেওয়া হলেও আরেক ভাইস চেয়ারম্যানের ভাগ্য এখনো ঝুলে আছে। দলের বেশ কয়েকজন নেতা পর্যবেক্ষণে রয়েছেন বলে জানা গেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ পরপর তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির দায়ে দলে তারা শুদ্ধি অভিযান চালায়নি। এমনকি কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেয়নি। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরে যা যা করণীয় ছিল তা দলটি করেনি। বরং জজ মিয়া নাটকের জন্ম দিয়েছে। এই গ্রেনেড হামলার বিষয়ে বিএনপি কোনো বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি। সর্বশেষ তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছিল বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে বিএনপি এখনো দ্বিধাবিভক্ত। নানা ইস্যুতেও বিএনপি এক সুর ধারণ করতে পারেনি। ২০১৪ সালে ভোটের আগে ও পরে পেট্রোলবোমার নাশকতায় বিএনপির ওপর দায় চাপানো হয়। বিএনপি যে এর সঙ্গে যুক্ত ছিল না তার বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি দলটি।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগমুহূর্তে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ফোনে বেগম জিয়ার সাড়া না দেওয়াও ছিল বিএনপির বড় ভুল। ওই সময় পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও সাড়া দিয়ে বিএনপির গণভবনের আমন্ত্রণ নেওয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বেগম জিয়ার সাক্ষাৎ না করা, পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে হঠাৎ করেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা, গণভবনে সংলাপে যাওয়া, প্রধানমন্ত্রীর কাছে গ্রেফতার হওয়া নেতা-কর্মীদের একটি তালিকা ধরিয়ে দেওয়াও ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। আবার সংসদে যোগদান প্রশ্নে দ্বৈত নীতি, ভোটের পরে জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতিকে বিসর্জন দেওয়াও ভুলের রাজনীতি হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। এ ছাড়া দলের শীর্ষ নেতৃত্বে সন্দেহ-অবিশ্বাস চরম আকার ধারণ করেছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে আস্থাহীনতাও দলের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। এদিকে জামিন বা আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তির কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করে মুক্তি নেওয়াটাকেও ভালোভাবে নেননি দলটির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সরকারের দয়ায় আপাতত মুক্তি পেয়েছেন খালেদা জিয়া। বেগম জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে জোরালো আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারছে না বিএনপি। নেতা-কর্মীরা স্বীকারও করছেন, দেশে প্রতিনিয়ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, ধর্ষণ বা অর্থ পাচার ইস্যু নিয়ে বড় কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি বিএনপি। জনগণের সমস্যা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, খাদ্যে ভেজাল, ব্যাংকে তারল্য সংকট, যানজট, ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া, পুঁজিবাজার ধ্বংস করে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করা, লাখো শিক্ষিত বেকারের চাকরি না হওয়া, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির ইস্যুকেও কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুও হাতছাড়া করে দলটি। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো ব্যাখ্যাও তৃণমূলকে দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দল করে জনগণ। তরুণ, শ্রমিকরাও পাশে থাকে। কিন্তু বিএনপির পাশে নেই তরুণ বা শ্রমিকরা। নতুন তরুণরা বিএনপিতে আসছে না। বিএনপি নেতাদের ছেলে-মেয়েরাও রাজনীতি করছে না। কিন্তু হুট করে এসেই নেতৃত্বে আসে, মনোনয়ন পায়। এ নিয়ে ক্ষোভও হয়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও এক। পরিবারতন্ত্র আছে দুই দলেই। এর পরও বিএনপির পেছনে জনসমর্থন আছে। সরকারের অনেক নেতিবাচক ভোটও তারা পাবে। কিন্তু নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট না হলে বিএনপি আসবে না। কিন্তু সেটা আদায় করার সক্ষমতা বিএনপির নেই। এটা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ছিল।’

সর্বশেষ খবর