শুক্রবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ

রিমান্ডে মানা হচ্ছে না উচ্চ আদালতের নির্দেশনা - আইনজ্ঞদের অভিমত, আইনের ধারা সংশোধন হলেই বন্ধ হবে

আরাফাত মুন্না

‘পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই শামীম আল-মামুনের বিরুদ্ধে আসামিদের মারধর, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে স্বীকারোক্তি প্রদানে বাধ্য করার অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।’ এ বক্তব্যটি নারায়ণগঞ্জের কিশোরীকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে করা এক মামলার বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের মতামত অংশের। আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার ১৪ দিন পরই জীবিত ফিরে আসে কিশোরী। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তিন আসামিই এখন জামিনে মুক্ত।

এ ঘটনার মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ প্রক্রিয়াটি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হলো। শুধু এ ঘটনাই নয়, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো ঘটনা অসংখ্য, যেখানে ঘটনায় জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে পুলিশ আসামিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। নারায়ণগঞ্জে কথিত মৃত কিশোরী ফিরে আসার ঘটনা নতুন করে উসকে দিয়েছে সে বিতর্ক। আইনজ্ঞরা মনে করেন, ধারাবাহিকভাবে এমন ঘটনা ঘটতে থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় নেওয়া এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কেউ। ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাই কোর্ট। ২০১৬ সালের ২৫ মে দেওয়া রায়ে হাই কোর্টের রায়ই বহাল রাখে আপিল বিভাগ। তবে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সেই ১৫ দফা নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। আইনজ্ঞরা বলেন, হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি-সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা সংশোধন হলেই নির্যাতন করে জবানবন্দি দেওয়ার পথ বন্ধ হবে। তবে আইন সংশোধন হওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানা বাধ্যতামূলক। তিন দশক আগে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রাজধানীর রমনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী সগিরা মোর্শেদ খুন হন। তখন মিন্টু নামের একজনকে গ্রেফতার করে স্বীকারোক্তি আদায় করেছিল পুলিশ। পরের বছর অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছিল, যার ভিত্তিতে বিচার চলছিল। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ওই হত্যাকান্ডে জড়িত সগিরা মোর্শেদের স্বামীর ভাইসহ চারজন। গত বছর বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০০৪ সালে রাজধানীর শাহবাগে শেরাটন হোটেলের (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল) মোড়ে বিআরটিসির দোতলা একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা অন্যতম। ওই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে নিহত হন ১১ যাত্রী। এ মামলায় কালু নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে অধিকতর তদন্তে জানা যায়, ঘটনার সময় অন্য মামলায় জেলহাজতে ছিলেন কালু। কালু জানান, তাকে জবানবন্দি শিখিয়ে দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। এ ঘটনায় হাই কোর্টের নির্দেশে ওই পুলিশ কর্মকর্তার চাকরি যায়। একই বছর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা) শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলার মামলায় জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও ধরা পড়ে যায়, যা এখন ‘জজ মিয়া নাটক’ নামেই বেশ আলোচিত। জানতে চাইলে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা উঠে যাবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ও বিচারক সবাইকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। তিনি বলেন, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে হাই কোর্টের ১৫ দফা নির্দেশনা রয়েছে। আপিল বিভাগও তা বহাল রেখেছে। তাই কেউ যদি ওই নির্দেশনাগুলো না মানে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনেক সময়ই রিমান্ডে নিয়ে আসামিকে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের অভিযোগ পাওয়া যায়। মাঝেমধ্যেই শুনি, যে ব্যক্তিকে খুন করার দায় স্বীকার করে আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, সেই খুন হওয়া ব্যক্তিই ফিরে আসছে। এসব ঘটনা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার পদ্ধতিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি-সংক্রান্ত আইনের ধারা সংশোধন করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

উচ্চ আদালতের ১৫ দফা নির্দেশনা : হাই কোর্টের রায়ের উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা হলো- আটকাদেশের (ডিটেনশন) জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেফতারের সময় পুলিশ নিজের পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। আটক ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ। গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে আটক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে আটক ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেফতার ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। আটক ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে স্বচ্ছ কাচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তদন্ত কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে পুলিশ সর্বোচ্চ তিন দিন হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতার ব্যক্তি মারা গেলে তৎক্ষণাৎ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। আটক ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন।

সর্বশেষ খবর