শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

তবু বেসামাল ঢাকা

নাজুক ফুটপাথ, ভাঙাচোরা সড়ক, খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই, ভয়াবহ দূষণ সংকট গণশৌচাগারের, মশার উপদ্রব, গণপরিবহনে নৈরাজ্য

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

তবু বেসামাল ঢাকা

রাজধানী ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক শহরে পরিণত করতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। তবু বেসামাল ঢাকা। সংকটের শেষ নেই দুই সিটিতে। বারবার উচ্ছেদ সত্ত্বেও দখলমুক্ত হয়নি ফুটপাথগুলো। ভেঙে গেছে অনেক ফুটপাথ। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অলি-গলি। অনেক ম্যানহোলে ঢাকনা নেই। উঁচু-নিচু মূল সড়ক, কোথাও আবার এক-দেড় ফুট গর্ত। ফের ট্রাক-পিকআপের দখলে চলে গেছে তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকার সড়কগুলো। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা দখল করে গড়ে উঠেছে ভবন। শীত আসতেই মশার উৎপাতে ঘুম হারাম নগরবাসীর। বিশ্বের শীর্ষ দূষিত নগরীর তালিকায় বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম। নানা উদ্যোগেও গণপরিবহনে ফেরেনি শৃঙ্খলা। যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামায় যানজটে স্থবির নগরজীবন। গণশৌচাগার সংকটে  পুরো শহরটাই যেন পরিণত হয়েছে শৌচাগারে। পার্কিং সংকটে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে গাড়ি চালকদের। আবার যত্রতত্র পার্কিংয়ে তৈরি হচ্ছে যানজট। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতায় বছরজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি।

নাজুক ফুটপাথ : চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে রাজধানীর অনেক ফুটপাথ। কোথাও ভেঙে গেছে। কোথাও আবার নেই ম্যানহোলের স্লাব। মেরুল বাড্ডা থেকে শাহজাদপুর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে ফুটপাথে স্লাব নেই। গণশৌচাগারের অভাবে ফুটপাথ ঘেঁষে প্রস্রাব করছে মানুষ। বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পরও পল্টন, গুলিস্তান, নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাথগুলো এখনো হকারের দখলে। বাধ্য হয়ে অনেকে ফুটপাথ ছেড়ে মূল সড়ক দিয়ে চলাফেরা করছেন। গত ডিসেম্বরেই মানিক মিয়া এভিনিউতে সাইকেল লেনের ওপরে অবৈধ স্থাপনা, পার্কিং ও ভাসমান দোকান উচ্ছেদে একাধিকবার অভিযান চালাতে হয়েছে ডিএনসিসিকে। তবে হকাররা বলছেন, রাজধানীতে কয়েক লাখ পরিবার বেঁচে থাকে ফুটপাথে ও রাস্তায় ব্যবসা করে। নির্দিষ্ট জায়গা পেলে তারাও ফুটপাথে বসতেন না।

তবুও ভাঙাচোরা সড়ক : এক দশকের ব্যবধানে অনেকগুলো ইউলুপ ও ফ্লাইওভার চালুসহ উন্নত হয়েছে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। তারপরও রাজধানীর সড়ক নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। বছরজুড়ে বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়িতে জনভোগান্তি লেগেই থাকছে। রাজধানীর এয়ারপোর্ট থেকে আবদুল্লাহপুর সড়কটি গত কয়েক বছরে একাধিকবার সংস্কার করতে দেখা গেলেও পুরো সড়কটি উঁচু-নিচু। মাঝে মধ্যেই গর্ত। কোথাও উঠে গেছে সুড়কি। আবার কোথাও উঁচু হয়ে আছে জমাটবদ্ধ কংক্রিট। ব্যস্ততম এই সড়কের অধিকাংশ ম্যানহোলের ঢাকনা সড়ক থেকে ২-৩ ইঞ্চি উঁচু বা নিচু, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া কিছু অভিজাত এলাকা বাদে অধিকাংশ ওয়ার্ডের শাখা সড়ক ও অলি-গলির সংস্কার নেই দীর্ঘদিন। দুই সিটির নতুন ৩৬টি ওয়ার্ডের সড়কের অবস্থা খুবই নাজুক। ২০১৭ সালে গঠিত এসব ওয়ার্ডের মধ্যে দক্ষিণ সিটির কিছু ওয়ার্ডে রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ শুরু হলেও উত্তরে এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। পুরনো ওয়ার্ডগুলোর শাখা সড়ক ও গলিপথগুলোও খানাখন্দে ভরা। ম্যানহোলের ঢাকনা বা স্লাব নেই অনেক স্থানে। অবৈধ দখলে সরু হয়ে গেছে অলি-গলি। এসব গলিপথে যানজট লাগলে তা মুক্ত হতে ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। ডিএনসিসির ভাটারার ছোলমাইদ এলাকার মাদরাসাতুল মানার মাদরাসার সামনেই মাঝরাস্তায় ম্যানহোলের স্লাব নেই দীর্ঘদিন ধরে। ফলে একসঙ্গে দুটি গাড়ি পার হওয়া অসম্ভব। নতুনবাজার থেকে ছোলমাইদ পর্যন্ত বেহাল সড়কটি গত ৭-৮ বছরের মধ্যে সংস্কার হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা। খিলক্ষেতের বরুরা এলাকায় ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে যান চলাচলই দুষ্কর। ডিএনসিসির ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের সাতারকুল এলাকার সংযোগ সড়কগুলো সরু ও অধিকাংশই কাঁচা। গত নির্বাচনের আগে রাস্তাঘাট সংস্কারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন এখানকার সব কাউন্সিলর প্রার্থী। স্থানীয় কাউন্সিলর আবদুল মতিন বলেন, অর্থ ছাড় না হওয়ায় নতুন ওয়ার্ডগুলোয় কাজ শুরু হয়নি। তবে অর্থ বরাদ্দ হয়ে আছে। জানুয়ারিতে ছাড় হওয়ার কথা ছিল। এখন শুনছি, করোনার কারণে বিভিন্ন প্রণোদনা ও মেগা প্রজেক্টগুলো চালু রাখতে গিয়ে অর্থের সংকট আছে। মার্চের আগে হবে না।

ফের বেদখল তেজগাঁওয়ের সড়কগুলো : তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের আশপাশের সংযোগ সড়কগুলো আবারও ট্রাকের দখলে চলে গেছে। রাস্তা দখল করে দিন-রাত চলছে ট্রাক মেরামত ও রং করার কাজ। ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক দীর্ঘ ৪০ বছর পর সড়কগুলো উদ্ধার করে যান চলাচলের ব্যবস্থা করেছিলেন। ট্রাক শ্রমিক নেতারা বলছেন, এখানে প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি ট্রাক থাকে। ৫ হাজার ট্রাক আসা-যাওয়া করে। এত ট্রাকের ধারণক্ষমতা ট্রাকস্ট্যান্ডের নেই। এ ব্যাপারে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা অভিযানে গেলে ট্রাকগুলো সরে যায়। অভিযানের পর আবার ফিরে আসে। বিষয়টির স্থায়ী সমাধানের জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছে জমি চাইবে ডিএনসিসি। জমি পাওয়া গেলে সেখানে আন্ডারগ্রাউন্ড এবং মাটির ওপরে মাল্টিলেভেল পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

ভয়াবহ দূষণের কবলে ঢাকা : পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বায়ুদূষণের কবলে এখন ঢাকা। গত ডিসেম্বরজুড়ে ঘুরেফিরে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছিল ঢাকার নাম। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় বায়ুমান সূচকে গড় দূষণ ছিল ১৮১, ২০১৭ সালে ১৮৯,  ২০১৮ সালে ২০৭, ২০১৯ ছিল ১৭৩ এবং ২০২০ সালে সেটা বেড়ে হয় ২৩৭। এর মধ্যে গত ৬ ডিসেম্বর বায়ুমান সূচক ছিল ৩১০, যাকে দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছাড়া বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, উন্মুক্তভাবে নির্মাণসামগ্রী পরিবহন, যানজট, পুরনো গাড়ির ধোঁয়া, রাস্তার ওপর নির্মাণসামগ্রী রাখা, ইটভাটা, বিভিন্ন সেবা সংস্থার বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে ঢাকার বাতাস।

গণশৌচাগার সংকটে দূষিত নগর : প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার মেগা সিটি ঢাকায় প্রতিদিন রাজপথে চলাচল করছেন ৫০ লাখের বেশি মানুষ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রতিনিয়ত হয়রানি হতে হচ্ছে গণশৌচাগারের খোঁজে। নগরীতে চলাচলরত প্রতি ৭৬ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একটি গণশৌচাগার। পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যেও মেলে না তার একটি। বাধ্য হয়ে রাস্তার আশপাশেই ফাঁক খুঁজে প্রাকৃতিক কর্ম সারছেন অনেকে। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। রাজধানীর অনেক ফুটপাথই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে শুধু মানববর্জ্যরে কারণে। সিটি করপোরেশনের মার্কেটগুলোয় গণশৌচাগার থাকলেও অধিকাংশ মার্কেটে শৌচাগারগুলো তালা দিয়ে রাখে মার্কেট সমিতি। ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, দুই সিটিতে শতাধিক নতুন গণশৌচাগার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কিছু চালু হলেও অধিকাংশই নির্মাণ করা যাচ্ছে না জায়গার অভাবে।

বিষফোঁড়া পার্কিং সংকট : পার্কিং সংকট রাজধানীর অন্যতম বিষফোঁড়ায় পরিণত হয়েছে। নির্মাণ বিধিমালা না মেনে পার্কিং ছাড়াই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মার্কেট ও বাণিজ্যিক ভবন। ফলে এসব স্থানে যাতায়াতকারী মানুষ গাড়ি রাখছেন ভবনের সামনের রাস্তায়। এতে বিঘ্ন ঘটছে অন্যান্য যান চলাচলে। অনেকে টাকা খরচ করে গাড়ি পার্কিং করতে চাইলেও আশপাশে পাচ্ছেন না সেই সুযোগ। রাজধানীতে কয়েকটি আধুনিক পার্কিং গড়ে উঠলেও সেগুলোর ঠিকানা জানেন না অধিকাংশ মানুষ। এ ছাড়া গন্তব্যস্থল থেকে সেসব পার্কিং দূরে হওয়ায় অনেকেই যানজট ঠেলে সে পর্যন্ত যাচ্ছেন না। এতে রাস্তার বড় একটি অংশ পার্কিংয়ের দখলে চলে যাওয়ায় যানজট তীব্র হচ্ছে।

খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই : ঢাকার ৫৬ সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে একই রাস্তা বারবার খুঁড়ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কখনো পানির লাইন, কখনো বিদ্যুতের ক্যাবল, কখনো ফাইবার অপটিক ক্যাবল, কখনো গ্যাসের পাইপ বসাতে খোঁড়া হচ্ছে। এতে একদিকে জনভোগান্তি লেগেই থাকছে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হচ্ছে। উন্নয়ন কাজের পরিকল্পনা আগে থেকে জানাতে দুই সিটি করপোরেশন সংস্থাগুলোকে মৌখিক ও লিখিতভাবে বললেও সাড়া দেয়নি অধিকাংশ সংস্থা।

মশার উপদ্রবে নাজেহাল : করোনার মধ্যে দুই সিটির মশক নিধন অভিযান বন্ধ থাকলেও গত বছর কম ছিল এডিস মশার (ডেঙ্গু) উপদ্রব। সারা বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৪০৫ জন। আগের বছর নানা উদ্যোগের পরও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন লক্ষাধিক। তবে শীত আসতেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে কোথাও নিস্তার মিলছে না। সিটি করপোরেশন আবার মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। নগরবাসী বলছেন, বিকালে ফগার মেশিন দিয়ে ঝোপঝাড়ে স্প্রে করার পর মশা এসে ঘরের ভিতরে ঢোকে। কয়েল, স্প্রে, বৈদ্যুতিক ব্যাট কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা গত বছর ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালিয়েছি। তবে শীতের সময় ড্রেন, জলাশয়ে প্রবহমান পানি না থাকায় কিউলেক্স মশা বংশবিস্তার করে। কিউলেক্স মশার বংশবিস্তার রোধে লার্ভিসাইডিং করা হচ্ছে, ফগিংও চলছে। মশা নিয়ন্ত্রণে আমরা চতুর্থ প্রজন্মের নোভালিউরন ওষুধ প্রয়োগ শুরু করেছি। খুব দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।

শৃঙ্খলা ফেরেনি গণপরিবহনে : সাজা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন করলেও শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজধানীর গণপরিবহনে। সবগুলো লেন আটকে বাসের যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা চলছেই। এতে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবার বাস রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দুই সিটির মেয়র সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকও করেছেন। তবে সে সুফল পেতে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা এখনো অনিশ্চিত।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর