শনিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ট্রাম্পের অপসারণ সময়ের ব্যাপার!

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

ট্রাম্পের অপসারণ সময়ের ব্যাপার!

নিজের অপরাধকে ক্ষমা করার উপায় নিয়ে আইনজীবী এবং সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম ঘৃণিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সর্বশেষ গত বুধবারের আচরণে ট্রাম্প নিশ্চিত যে, বিদায় নেওয়ার পর ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায় মুক্তি’র বিধি তাঁর ক্ষেত্রে হয়তো প্রযোজ্য হবে না। শেষ ১২ দিন তাঁর কীভাবে কাটবে, আদৌ হোয়াইট হাউসে থাকতে পারবেন কি না সে শঙ্কাও ক্রমান্বয়ে প্রবল হচ্ছে। কারণ কংগ্রেসের উভয় কক্ষের ‘কতিপয় ট্রাম্প সমর্থক’ ছাড়া সবাই চাচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব ট্রাম্পকে সরিয়ে দিতে। কেউ প্রকাশ্যে, আবার কেউ আড়ালে সে কথাই উচ্চারণ করছেন। ট্রাম্প যে কোনো সময় আরও ভয়ংকর এবং অবিশ্বাস্য কিছু করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রেই শুধু নয়, সুদীর্ঘ একটি ইমেজকে ধূলিসাতের পথে ঠেলে দিতে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। ডেমোক্র্যাট শাসিত প্রতিনিধি পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বশেষ আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং ট্রাম্পের মন্ত্রীদের। তাঁরা যদি দুই দিনের মধ্যে সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগ করে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ট্রাম্পকে সরিয়ে না দেন তাহলে সামনের সপ্তাহেই ইমপিচমেন্টের বিল উঠাবেন।

ইতিমধ্যেই প্রতিনিধি পরিষদের বিচারবিভাগীয় কমিটির বেশির ভাগ ডেমোক্র্যাটই ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। সে চিঠিতেই তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ক্যাপিটল হিলে হামলা উসকে দিয়ে গণতন্ত্রকে অবমাননা করার চেষ্টা’র অভিযোগ করে বলেছেন, সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগ করে তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। শুক্রবার সকালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ম্যাসাচুসেটসের কংগ্রেসম্যান ক্যাথারিন এম ক্লার্ক জানিয়েছেন, বুধবারের মধ্যেই ট্রাম্পকে ইমপিচের ব্যাপারে প্রতিনিধি পরিষদে ভোট হতে পারে। যদি মঙ্গলবারের মধ্যে মাইক পেন্সসহ মন্ত্রীরা ট্রাম্পকে না সরায়। উল্লেখ্য, প্রতিনিধি পরিষদের শীর্ষ চতুর্থ পদধারী (হাউস ককাস) এই কংগ্রেসম্যান শুক্রবার সকালেই সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কনফারেন্স কলে মিলিত হয়েছেন। সে সময় তিনি বলেছেন, ট্রাম্পের মতো বিশ্বাসঘাতক, অথর্ব এবং মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে যত দ্রুত সরানো যাবে ততই মঙ্গল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এবং জাতীয় নিরাপত্তার। তবে আগের মতো এবারও রিপাবলিকান শাসিত সিনেট ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট বিল পাসে সম্মত হবে কিনা তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছেন না। যদিও সিনেটর মিচ ম্যাককনেল আগের অবস্থানে নেই। তিনিও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন এবং নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয়ে পড়েছেন। তবে ইলেকটোরাল ভোটের সার্টিফিকেট প্রদানকালের ভূমিকা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তাঁর ব্যাপারে স্বস্তি এনেছে বলেও অনেকের ধারণা।  

উল্লেখ্য, ২৫তম সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো প্রেসিডেন্ট শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থতার কারণে ‘দায়িত্ব পালনে অক্ষম’ হলে মেয়াদ শেষের আগেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া যায় এবং ক্ষমতা সাময়িক কিংবা স্থায়ীভাবে ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেওয়া যায়। এই সংশোধনীর চার নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না পারলে তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পদক্ষেপ নিতে পারেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরাতে প্রতিটি চেম্বারেই (সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ) প্রয়োজন পড়বে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের।

উল্লেখ্য, বুধবার কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের জয়ের স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলার সময় ক্যাপিটল হিলে ঢুকে ব্যাপক তান্ডব চালায় ট্রাম্প-সমর্থকরা। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালাতে হয় পুলিশকে। এতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। স্তম্ভিত হয়েছে গোটা বিশ্ব। দাবি উঠেছে রাজপথ এবং সুধীসমাজে ট্রাম্পকে সরানোর। বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ট্রাম্পকে সরে যাওয়ার দাবিতে বিশেষ সম্পাকীয় প্রকাশ করেছে। ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ট্রাম্পকে সরানোর ডাক দিয়ে বলা হয়েছে, তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আরও কয়েকটি সংবাদপত্রেও ধ্বনিত হয়েছে একই সুর। সিএনএনসহ শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম থেকে ট্রাম্পের মতিভ্রমসহ অ-আমেরিকান কর্মকান্ডের ধারাবিবরণী উপস্থাপন করা হচ্ছে। কীভাবে হোয়াইট হাউস এবং প্রেসিডেন্ট পদের অপব্যবহার করে চলছেন ট্রাম্প- এসব ঘটনাও অবলীলায় প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। সে ভয় থেকেই সর্বশেষ সাবেক ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামা টুইটারসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে শুক্রবার অনুরোধ জানিয়েছেন ট্রাম্পকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে। কারণ, তিনি হচ্ছেন মানবতার শত্রু, গণতন্ত্রের দুশমন।

সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার অবিলম্বে ট্রাম্পকে সরানোর ডাক দিয়ে বলেছেন, তাঁর আর এক দিনও ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। খোদ ট্রাম্পের মন্ত্রিসভাই তাঁকে সরাতে ২৫তম সংশোধনী নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে বলে জানানো হয়েছে সিবিএস নিউজ এবং সিএনএনের প্রতিবেদনেও। সিএনএন সংবাদদাতা জানিয়েছেন, আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সিবিএস নিউজ জানায়, মাইক পেন্সের কাছে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রস্তাব দেওয়া হয়নি। তাছাড়া মন্ত্রিসভায়ও ট্রাম্পকে সরানোর পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন আছে কি না তাও এখনো পরিষ্কার নয়। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, ২৫তম সংশোধনীর চতুর্থ ধারা ১৯৬৭ সালে এই সংশোধনী গৃহীত হওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত কখনো ব্যবহার করা হয়নি। তারপরও এ পদ্ধতিতেই ট্রাম্পকে সরানোর ডাক ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। কিছু রিপাবলিকানও এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন দিচ্ছেন।

এদিকে, ক্রান্তিকালে যথাযথ ভূমিকায় অবতীর্ণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বদলে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি উভয় দলের আস্থা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল হিলে হামলা চালানোর সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চেয়ে ত্বরিত গতিতে কাজ করতে দেখা গেছে ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে। বাজে পরিস্থিতি সামাল দিতে তখন মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন তিনিই। ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করে বিক্ষোভ সামলানোর ব্যবস্থা করা, এমনকি পেন্টাগনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ন্যাশনাল গার্ড ডাকার কাজটিও তিনিই করেছেন। ট্রাম্প তখন ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। তাঁকে এমনকি ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করতে রাজিও করাতে হয়েছে বলে জানিয়েছে সিএনবিসি নিউজ। ফলে পেন্সই সংকটকালে বিশেষ ভূমিকা রেখে প্রকৃত নেতা হয়ে উঠেছেন। এতে প্রচ- ক্ষুব্ধ ট্রাম্প। এমনও মন্তব্য করেছেন, তিনিই নাকি তাঁকে (পেন্স) এ পর্যন্ত এনেছেন, সম্মানিত করেছেন।  এদিকে তালে মাতাল হলেও ট্রাম্প অবশ্য পরে নানা কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় ওভাল অফিস থেকে সমর্থকদের তান্ডব দেখার প্রায় এক ঘণ্টা পর টুইট করে তিনি বিক্ষোভকারীদের ‘শান্ত থাকা উচিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ট্রাম্প জানুয়ারির ২০ তারিখ নিয়ম অনুযায়ী তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে তিনি তাঁর মিথ্যা দাবির পুনরাবৃত্তি করেছেন এমনকি বিক্ষোভকারীদের ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্পের এই তালগোলে তাঁর ওপর আর ভরসা নেই। অনেকেই তাঁকে আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় দেখতে চাইছেন না, চলছে আলোচনাও।

এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাইডেনকে ২০ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্মতি সম্পর্কিত একটি ভিডিও-বার্তা প্রচারের পর থেকেই ট্রাম্প নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। জনসমক্ষে আসেননি কিংবা নয়া কোনো কর্মসূচির তথ্যও জানা যায়নি। তিনি চাচ্ছেন কোনোমতে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত নিজের অবস্থান ধরে রাখতে। স্ত্রী-সন্তানসহ ঘনিষ্ঠরা এই পরামর্শ দিয়েছেন বলে শোনা গেছে। অন্যথায় তাঁকে নিশ্চিত জেলে যেতে হবে ২০ জানুয়ারি বিকালেই- এমন ভয়ও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিজের অপরাধ থেকে ক্ষমা পেতে পারেন কি না, এমন কোনো ব্যবস্থা সংবিধানে আছে কি না, তা নিয়েও আইনবিদদের পরামর্শ চাচ্ছেন বলে শুক্রবার সকালের সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর