মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বক্তৃতা দিয়ে ভাতা গ্রহণ প্রশ্নের মুখে ইসি

গোলাম রাব্বানী

বক্তৃতা দিয়ে ভাতা গ্রহণ প্রশ্নের মুখে ইসি

নির্বাচনী প্রশিক্ষণের ব্যয় নিয়ে অডিট আপত্তির মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একাদশ জাতীয় সংসদ ও পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণে ‘বিশেষ বক্তা’ ও ‘কোর্স উপদেষ্টা’ হিসেবে বক্তৃতা দিয়ে টাকা নেওয়ার বিষয়ে এ আপত্তি তুলেছে স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদফতর। প্রশ্ন উঠেছে ৪০ কোটি টাকার ট্যাব কেনাকাটা ও নির্বাচনী প্রশিক্ষণের জন্য নতুন নতুন পদ সৃষ্টি নিয়েও। এ ছাড়া কোর্স পরিচালকের ভাতা নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি পরিশোধের অভিযোগও রয়েছে।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, দুই নির্বাচনের প্রশিক্ষণে বিশেষ বক্তার তালিকায় ছিলেন সিইসি এবং চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির তৎকালীন সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবরা। আর কোর্স উপদেষ্টা ছিলেন তৎকালীন ইসি সচিব।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, পরিকল্পনায় ১৫ জন বিশেষ বক্তার সম্মানী ভাতা বাবদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ কোটি ৪ লাখ এবং উপজেলা নির্বাচনের জন্য ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার সংস্থান রাখা হয়। ১৫ জন বিশেষ বক্তা প্রশিক্ষণ দিয়ে সম্মানী গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ কোর্সের উপদেষ্টা হিসেবে ইসি সচিব সম্মানী নিয়েছেন। ইসি সূত্র জানিয়েছেন, বিগত ওই দুই নির্বাচনে সারা দেশে প্রশিক্ষণের ৭ কোটি টাকার ব্যয় নিয়ে অডিট আপত্তি এসেছে। এর মধ্যে নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ব্যয় হওয়া ৪৭ লাখ টাকা, বিধিবহির্ভূতভাবে সম্মানী প্রদানের কারণে ১ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা; বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা ও সুপারভাইজিং প্রশিক্ষকসহ অন্যান্য অননুমোদিত পদের ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ভাতা দেওয়া নিয়েও অডিট আপত্তি রয়েছে। এ ছাড়া কোট পরিবর্তনের কারণে ২ কোটি ৭৯ লাখ ৭০ হাজার ৪৭৫ টাকার ব্যয় নিয়েও আপত্তি তোলা হয়েছে। এ ব্যয়ের পর্যালোচনায় অডিট অধিদফতর বলেছে, নির্বাচনের সময় অফিস সময়ের পর অতিরিক্ত খাটুনির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যয় থেকে আপ্যায়ন ভাতা বাবদ এ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে গাড়ি মেরামত বাবদ ৬ লাখ ৭০ হাজার ৬৬৬ টাকার ব্যয় নিয়েও আপত্তি রয়েছে। অডিট অধিদফতর বলেছে, বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা, কোর্স মনিটরিং অফিসার, সুপারভাইজিং প্রশিক্ষকসহ নতুন সৃষ্ট যেসব পদের বিপরীতে যে ভাতা নেওয়া হয়েছে তা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত নয়। যদিও নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, কোর্স উপদেষ্টা, বিশেষ বক্তার পদ ইসি অনুমোদন দিয়েছিল। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অধীন নয়। তা ছাড়া রুলস অব বিজনেসেরও আওতাধীন নয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ইসির জন্য যে বরাদ্দ দেয় তা ব্যয়ের জন্য ইসিই চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। এখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রযোজ্য নয়। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘অডিট আপত্তি এসেছে। ইটিআই এবং সারা দেশের জেলা, উপজেলা নির্বাচনী অফিসে আমাদের এসব টাকা খরচ হয়েছে। আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি অডিট আপত্তির জবাব দেওয়ার জন্য। আমাদের কাছে জবাব চেয়েছে। আর জবাব যদি দিতে না পারি তবে টাকা ফেরত চেয়েছে। জবাব তৈরি করা হচ্ছে। অনেক জায়গা থেকে জবাব এসেছে।’ কী আপত্তি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অডিট বিভাগের আপত্তি হচ্ছে খাত ও হার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নয়।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আইনে বলা হয়েছে, ‘অনুমোদিত বাজেটের নির্ধারিত খাতে যে বরাদ্দ থাকে সেখান থেকে খরচ করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। যেহেতু আইনে এটা আছে তাই অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এটা অনুমোদন করা হয়নি এবং প্রয়োজন নেই বলে ইসি মনে করছে।’ ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের ৭৪তম বৈঠকে অডিট আপত্তির বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। অডিট আপত্তির বিষয়ে বৈঠকে কার্যপত্রে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে তিন ধরনের অডিট আপত্তির তথ্য পাওয়া যায়। ১. অনুমোদিত পদের বাইরে কোর্স উপদেষ্টার পদ রাখা উক্ত পদের ভাতা পরিশোধ করা। ২. অনুমোদিত পদের বাইরে বিশেষ বক্তার পদ রাখা উক্ত পদের ভাতা পরিশোধ করা। ৩. নির্ধারিত হার অপেক্ষা অধিক হারে কোর্স পরিচালকের ভাতা পরিশোধ করার বিষয়ে আপত্তি রয়েছে। বৈঠকে উপস্থাপিত একটি নিরীক্ষা জিজ্ঞাসাপত্রে (২০১৮-২০১৯) বলা হয়েছে, অনুমোদিত পদের বাইরে কোর্স উপদেষ্টার ভাতা পরিশোধ করায় সরকারের ১৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। অন্য একটি নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত পদের বাইরে বিশেষ বক্তার ভাতা পরিশোধ করায় তিনজন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আরেকটি নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, কোর্স পরিচালকের পদে নির্ধারিত সম্মানীর চেয়ে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৮০০ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষায় দেখা যায়, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচি ২০১৯ উপলক্ষে নিবন্ধিত দলের সদস্যদের প্রশিক্ষণ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচন উপলক্ষে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে বিভিন্ন পদে (বিশেষ বক্তা, কোর্স উপদেষ্টা, কোর্স মনিটরিং অফিসার, সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক, সহকারী কোর্স সমন্বয়ক, আঞ্চলিক কোর্স সমন্বয়ক, অতিরিক্ত আঞ্চলিক কোর্স সমন্বয়ক, জেলা কোর্স সমন্বয়ক ও অতিরিক্ত জেলা কোর্স সমন্বয়ক) দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কোর্সে উপস্থিত থাকার সপক্ষে প্রমাণক পাওয়া যায়নি। শুধু অ্যাকুইটেন্স রোলে স্বাক্ষর করে সম্মানী গ্রহণ করেছেন। একই ব্যক্তি একই প্রশিক্ষণে একই বিলের মাধ্যমে এ পদগুলোয় দায়িত্ব পালনের জন্য একাধিক সম্মানী গ্রহণ করেছেন। পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, দেখা যায় একই ব্যক্তি একই তারিখে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিক সম্মানী গ্রহণ করেছেন। সৃজিত পদের বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন অথবা আপত্তিকৃত এ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ইসির জবাবে বলা হয়, বিভিন্ন প্রশিক্ষণে সিইসি ও অন্য কমিশনাররা বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত হয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। দ্য চিফ ইলেকশন কমিশনার অ্যান্ড ইলেকশন কমিশনার (রেম্যুনেরেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস) অধ্যাদেশ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনাররা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মতো ভাতা ও সুবিধা প্রাপ্য হন। ইসির কর্মকর্তারা বলেছেন, সব আপত্তির বিষয়ে ইসি নিজেদের জবাব প্রস্তুত করছে। শিগগির জবাব পাঠানো হবে। ইসির জবাবের মাধ্যমে আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে আপত্তিকৃত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে হবে। না হলে শেষ পর্যন্ত এ আপত্তি যাবে জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটিতে।

জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ ও পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনসংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেয় ইসি। প্রশিক্ষক হিসেবে বিশেষ বক্তা এবং কোর্স উপদেষ্টার পদ তৈরি করা হয়। বিশেষ বক্তার তালিকায় ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির তৎকালীন সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্মসচিবরা। আর কোর্স উপদেষ্টা ছিলেন তৎকালীন ইসি সচিব। এর আগে কোনো নির্বাচনের প্রশিক্ষণে এ ধরনের পদ ছিল না। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব পদ তৈরি করা হয়। তবে প্রশিক্ষণসংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের যে নীতিমালা সেখানে এ ধরনের পদ নেই। ইসিও এসব পদের অনুমোদন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নেয়নি। ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের একজন উপপরিচালকের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। এ ছাড়া পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ৭৫০ টাকা। মোট দুই নির্বাচনে বরাদ্দ ছিল ১২৩ কোটি ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা। এ চিটিতেই বিশেষ বক্তা, কোর্র্স উপদেষ্টা, কোর্স পরিচালক ও সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক হিসেবে কারা থাকবেন সে বিবরণীও দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে দেখা গেছে, বিশেষ বক্তার নামের তালিকায় ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, চার নির্বাচন কমিশনার, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, মহাপরিচালক ইটিআই, যুগ্মসচিব (১), যুগ্মসচিব (২), যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও অর্থ), যুগ্মসচিব (জনসংযোগ), যুগ্মসচিব (আইন), যুগ্মসচিব (এনআইডি)। কোর্র্স উপদেষ্টার তালিকায় ছিলেন নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব। এ ছাড়া কোর্স পরিচালক ছিলেন (পঞ্চম উপজেলা পরিষদে) নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, ঢাকা। আঞ্চলিক পর্যায়ে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসার (আঞ্চলিক কোর্স সমন্বয়ক), অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসার (অতিরিক্ত আঞ্চলিক কোর্স সমন্বয়ক)। জেলা পর্যায়ে সিনিয়র জেলা/জেলা নির্বাচন অফিসার (জেলা কোর্স সমন্বয়ক) এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসার (সহকারী কোর্স সমন্বয়ক) হিসেবে ছিলেন। সুপারভাইজিং প্রশিক্ষক ছিলেন ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, মহাপরিচালক ইটিআই, যুগ্মসচিব (১), যুগ্মসচিব (২), যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও অর্থ), যুগ্মসচিব (জনসংযোগ), যুগ্মসচিব (আইন), যুগ্মসচিব (এনআইডি), আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ১০ জন, জেলা প্রশাসক ৬৪ জন, পুলিশ সুপার ৬৪ জন, সব উপসচিব (নিকস), পরিচালক সব (এনআইডি/ইটিআই), সব সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং সব রিটার্নিং অফিসার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর