শান্তিতে নোবেলজয়ী ও ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এমডি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পুরনো ব্যবস্থা আমাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। তিনি বলেন, আমরা জ্বলন্ত ঘরে বাস করছি। এই জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে আমরা বড় উৎসব আয়োজনে ব্যস্ত। আমরা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তির চমক উদ্যাপন করছি, উন্নয়নের জয়গান করছি; অথচ একেবারেই দেখতে পাচ্ছি না- এই উৎসবই আমাদের গৃহে লাগা আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে।
করোনা মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার এবং সরকার ও নাগরিকের কর্তব্য সম্পর্কে সম্প্রতি ব্রাজিলের এস্তাদো দে সাও পাওলো পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রফেসর ইউনূস এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ গতকাল গণমাধ্যমে পাঠায় ঢাকার ইউনূস সেন্টার। কভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে প্রফেসর ইউনূস বলেন, এই মহামারী অর্থনীতির মেশিনটা থামিয়ে দিয়েছে। মহামারী-পূর্ব অবস্থা থেকে অনেক পেছনে পড়ে গেছে পৃথিবী। এখন সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মহামারীর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। যাতে প্রবৃদ্ধির সেই গতিটা ফিরে পাওয়া যায়। আমি জোর দিয়ে বলতে চাইছি- এখন আমাদের নীতি হওয়া উচিত- মহামারী-পূর্ব সেই পৃথিবীতে ‘আর ফিরে যেতে চাই না’। কেননা সেটি ছিল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অল্প কিছু লোকের হাতে সম্পদের চরম কেন্দ্রীকরণ এবং পৃথিবীর বুকে মানুষকে অপাংক্তেয় করে দিয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আগ্রাসনের মাধ্যমে এই গ্রহে মানুষের অস্তিত্ব ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া। মহামারী-পূর্ব পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া হবে আত্মহত্যার শামিল। তিনি বলেন, ধ্বংস-অভিমুখী সেই আগের পথে আমরা কেন ফিরে যাব? ইউনূস বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই তরুণ সমাজ এটি বুঝতে পেরেছে। এ কারণে তারা রাজনৈতিক দল থেকে দূরে থাকতে চাইছে। কিশোর-কিশোরীরা ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ ব্যানারে নতুন ভবিষ্যতের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। সামাজিক সমস্যা ও নাগরিকের দায়িত্ব প্রসঙ্গে প্রফেসর ইউনূস বলেন, কোনো পরিস্থিতিতেই সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে নাগরিকরা নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানে নাগরিকদের অবশ্যই তাদের সব সৃজনশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের কাজ হবে নাগরিকদের উৎসাহ দেওয়া। তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া। তাদের অর্জনের প্রশংসা করা। নাগরিকদের বিভিন্ন উদ্যোগে সহায়তা দিতে উপযুক্ত আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে দেওয়া। সাক্ষাৎকারে ক্ষুদ্রঋণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, সরকারের উচিত হবে না, কোনো ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি পরিচালনা করা। কেননা সরকার এ কাজ করতে গেলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই কর্মসূচির রাজনীতিকরণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। এর ফলে এই কর্মসূচি দাতব্য কর্মসূচিতে পরিণত হবে। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। তিনি বলেন, সরকারের উচিত হবে উপযুক্ত আইনি কাঠামো সৃষ্টি করে মানুষকে ‘সামাজিক ব্যবসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ব্যাংক’ সৃষ্টির লাইসেন্স প্রদান করা, যে ব্যাংকগুলোর সঞ্চয় সন্নিবেশ করার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। এই লাইসেন্স অবশ্যই ব্যক্তিগত মুনাফা-সন্ধানী ব্যাংক তৈরির জন্য দেওয়া হবে না; এটি করা হলে এই ব্যাংকগুলো শিগগিরই মহাজনী ব্যাংকে পরিণত হবে।