শুক্রবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ইমপিচ হলেও শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন ট্রাম্প

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

ইমপিচ হলেও শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন ট্রাম্প

অভিশংসিত (ইমপিচ) হলেও মেয়াদ পূর্ণ করেই ২০ জানুয়ারি দুপুরে বিদায় নেবেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ভবিষ্যতে তিনি যাতে পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী অথবা অন্য কোনো ফেডারেল প্রশাসনের অংশ হতে না পারেন সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জো বাইডেন আমলেই সিনেটে তাঁর বিচার হবে প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়া বিলের পরিপ্রেক্ষিতে। একই  সঙ্গে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ট্রাম্প যাতে অবসরভাতা, সিক্রেট সার্ভিস সুবিধাসহ সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোনো সুযোগ-সুবিধা না পান সে ব্যবস্থাও করা হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ট্রাম্পকে রিপাবলিকান পার্টি থেকেও এসব কারণে অপসারিত হতে হবে। অর্থাৎ বড় ধরনের একটি ভাঙন থেকে রিপাবলিকান পার্টি অব্যাহতি পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আরেকটি নজির স্থাপন করলেন দুবার অভিশংসিত হয়ে। বুধবারের অভিশংনের সিদ্ধান্ত হলো আগের বুধবার ক্যাপিটল হিলে সহিংস বিদ্রোহে উসকানি দেওয়ার জন্য। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের এ প্রস্তাবটি পাস হয় ২৩২-১৯৭ ভোটে। ভোটদানে বিরত ছিলেন চারজন। অভিশংসনের পক্ষে ডেমোক্র্যাটদের কাতারে শামিল হন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির মেয়ে লিজ চেনিসহ ১০ রিপাবলিকান নেতা। এটি উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা অভিশংসনের ইতিহাসে। প্রসঙ্গত, ট্রাম্পের অসম্মানজনক বিদায়ের পরিক্রমায় ‘বুধবার’ চিহ্নিত হয়ে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণের অবিস্মরণীয় ভূমিকার সঙ্গেও বুধবারের গুরুত্ব অপরিসীম হিসেবে বিবেচিত হবে। বুধবার ক্যাপিটল হিলে জঙ্গি হামলার সাত দিনের মাথায় আরেক বুধবার ট্রাম্পকে অভিশংসন এবং তারও সাত দিনের মাথায় বুধবারই ট্রাম্প আমলের অবসান ঘটিয়ে জনরায়ে বিজয়ী বাইডেন অভিষিক্ত হবেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রদ্রোহ, ঘুষ নেওয়া কিংবা অপরাধমূলক কাজে জড়িত হলে তাকে সরানোর অস্ত্র এ অভিশংসন। প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়া এ প্রস্তাব যাবে এখন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে শুনানিতে। ১০০ সদস্যের সিনেটে এখন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সমান সমান। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সম্মতি দিলে তবেই ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হবেন। আর সে প্রক্রিয়া সারতে ২০ জানুয়ারি পেরিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সে আভাস দিয়েছেন সিনেটের বর্তমান নেতা মিচ ম্যাককনেল। তিনি বলেছেন, সিনেটের অধিবেশন শুরু হবে ১৯ জানুয়ারি। পরদিন দুপুরে অভিষিক্ত হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। একই দিন অপরাহ্ণেই সিনেট লিডারের দায়িত্ব আসবে ডেমোক্র্যাট চাক শুমারের কাঁধে। এভাবেই ট্রাম্প দায়িত্বে না থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে বিচারকার্য পরিচালিত হবে। সে সময় রিপাবলিকানরাও ১৭ জন ভোট দিলেই দুই-তৃতীয়াংশ হয়ে ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হবে। এমন আভাস রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল দিয়ে রেখেছেন।

 কারণ রিপাবলিকানরা কখনই ট্রাম্পের মতো বদমেজাজি লোককে দলে দেখতে চান না। গত নভেম্বরে ভোটের পর হার স্বীকার না করে উল্টো কারচুপির উদ্ভট অভিযোগ তুলে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার দৃষ্টিকটু প্রয়াস চালান ট্রাম্প। বিভিন্ন স্টেট ও সুপ্রিম কোর্টে অর্ধশতাধিক মামলা করেছিলেন। ট্রাম্পের নিযুক্ত বিচারপতিরাও নির্বাচনে কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ আমলে নেননি। এরপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে জর্জিয়া স্টেটের রিপাবলিকান নেতাদের টেলিফোনে হুমকি দিয়েছিলেন তাঁর পক্ষে ভোট বাড়িয়ে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের।

সে অনুরোধও বুমেরাং হয়। রিপাবলিকান-শাসিত স্টেটের ইলেকটোরাল ভোট গণনায়ও জনরায় স্বীকৃতি হয়। তার পরই সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসে জো বাইডেনের স্বীকৃতির সময় জঙ্গি হামলায় মদদ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। ট্রাম্প সমর্থকরা ক্যাপিটল ভবনে নজিরবিহীন হামলা চালায়। তাতে নিহত হন পাঁচজন। ওই হামলার ঠিক আগেই ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে উগ্রতার প্ররোচনা ছিল বলে সব মহল থেকে সমালোচনা ওঠে। রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতাও এর সমালোচনায় ?মুখর হন। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালনের ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করে ট্রাম্পের হাত থেকে ক্ষমতা নিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের প্রতি আহ্বান জাপ্রণ কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট সদস্যরা। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে। এ সংশোধনীতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট যদি শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে ‘অপারগ’ হন তাহলে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন। ওই সংশোধনীর ৪ নম্বর ধারায় বলা আছে, প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না পারলে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য তাকে ‘দায়িত্ব পালনে অপারগ’ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু পেন্স সে আবেদনে সাড়া না দিলে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসনের প্রস্তাব আনেন ডেমোক্র্যাটরা। সাম্প্রতিক হামলার অভিজ্ঞতায় ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যে ক্যাপিটল ভবনে শুরু হয় প্রতিনিধি পরিষদের অধিবেশন; ভবনের ভিতর-বাইরে গিজগিজ করছিল নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। দেড় শ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের পর ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা এই প্রথম কংগ্রেস ভবনের ভিতরে অবস্থান নেন নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে। ভোটাভুটির আগে কয়েক ঘণ্টা উত্তপ্ত বিতর্ক চলে প্রতিনিধি পরিষদের অধিবেশনে। পরিষদের স্পিকার ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি সে সময় বলেন, ‘ইতিহাসকে এড়িয়ে যেতে আমরা পারি না। আমরা দেখেছি প্রেসিডেন্ট দাঙ্গায়, সশস্ত্র বিদ্রোহে উসকানি দিয়েছেন। তাঁকে (ট্রাম্প) যেতেই হবে। তিনি জাতির জন্য স্পষ্ট ও জাজ্বল্যমান এক হুমকি।’ স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বরাবরই ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনায় ?মুখর; গত বছর প্রেসিডেন্টের স্টেট অব দি ইউনিয়ন ভাষণের অনুলিপি ছিঁড়েছিলেন তিনি। এর বিরোধিতায় রিপাবলিকান নেতারা এ অভিশংসন প্রস্তাবকে ডেমোক্র্যাটদের বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করেন। তারা বলেন, সহিংসতা নিয়ে এখন উচ্চকণ্ঠ হলেও সম্প্রতি বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীরা সহিংস বিক্ষোভ করলেও তখন ডেমোক্র্যাটদের কোনো রা ছিল না। এ অভিশংসন বিল পাসের পর স্পিকার পেলোসি সেখানে স্বাক্ষরের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিডিওতে ট্রাম্পের বক্তব্য প্রচার করা হয়। সেটি পোস্ট করা হয়েছিল হোয়াইট হাউসের টুইট অ্যাকাউন্টে। এ বক্তব্যটি যদি ৬ জানুয়ারির হামলার সময় দেওয়া হতো তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিত বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মন্তব্য করেছেন। কারণ, এ বক্তব্যে ট্রাম্পের গত চার বছরের কোনো প্রকাশ ঘটেনি। অধিকন্তু সময়ের দাবিতে যা হওয়া উচিত তা ধ্বনিত হয়েছে। তিনি আন্দোলনের নামে রক্তপাত, ভাঙচুর, সহিংসতার নিন্দা করেছেন। এমন সহিংসতায় লিপ্তরা কখনই আন্দোলনের সহায়ক নয়। রিপাবলিকান পার্টি কিংবা তিনি নিজেও এমন সহিংসতায় বিশ্বাসী নন। তাই যারা আন্দোলনের নামে সহিংসতায় মেতে উঠতে চায় তারা যেন ঘরে ফিরে যায়। যারা আন্দোলনের নামে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে অবদমিত করে তারা আসলে তাঁর অনুগত নয় বলেও উল্লেখ করেছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এ ভাষণেও তিনি বাইডেনকে অভিনন্দন জানাননি কিংবা ২০ জানুয়ারি অভিষেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথাও বলেননি। ফলে সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক নিয়ে যে অস্বস্তি ও উত্তেজনার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভীতির সঞ্চার ঘটেছে তা অব্যাহত রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর