বুধবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

উৎসব শঙ্কার ভোট চট্টগ্রামে

প্রস্তুত ১১ হাজার ৭০০ ইভিএম । ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ । ভোট কেন্দ্র ৭৩৫ । মেয়র প্রার্থী ৭ সাধারণ ৪১ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ১৭২, সংরক্ষিত ১৪ ওয়ার্ডে ৫৭ । জন সাধারণ ছুটি নেই

রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, গোলাম রাব্বানী ও রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম থেকে

উৎসব শঙ্কার ভোট চট্টগ্রামে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে গতকাল সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় -দিদারুল আলম

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ভোট উৎসব আজ। নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি উত্তেজনা বিরাজ করছে বন্দর নগরীতে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নির্বাচন কমিশন। গতকাল সব কেন্দ্রে ইভিএমসহ নির্বাচনী মালামাল পাঠানো হয়েছে। নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে মাঠে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১৮ হাজার সদস্য। ভোট উৎসব পালনে প্রস্তুত ভোটার ও প্রার্থীরা। তবে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সংঘাত-সহিংসতার কারণে ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভোটার ও অনেক প্রার্থী। নির্বাচনী এজেন্ডা, গ্রেফতার নিয়ে গতকাল শেষ মুহূর্তে রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। সুষ্ঠু  ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোট হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। বিএনপির অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেছেন তিনি। এ নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থীসহ মেয়র পদে ৭ জন ও সংরক্ষিত ৫৭ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৭২ জন প্রার্থী। ভোটার রয়েছেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি দেশবাসীর নজর এখন চট্টগ্রাম সিটি ভোটে। চলছে জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ। সবার প্রত্যাশা সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের। জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নিরপেক্ষ ভোট হলে জয়ের আশা দেখছে বিএনপি। নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, দলীয় প্রতীকে প্রথম এ নির্বাচনে লড়াই হবে নৌকা-ধানের শীষের।

ভালো ভোটের আশা করছে নির্বাচন কমিশন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিদায়ের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি। কেননা চট্টগ্রাম সিটির মতো হাইপ্রোফাইলের নির্বাচন এই কমিশনের আমলে আর নেই। ইসির সিনিয়র সচিব বলেছেন, ‘একটা সুষ্ঠু এবং প্রতিযোগিতামূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আশা করি একটা ভালো নির্বাচন  দেখবেন।’ নির্বাচন কমিশন বলছে, সব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ভোটের আয়োজন হচ্ছে। সুরক্ষার সব ব্যবস্থাই কেন্দ্রে রাখা হবে। চট্টগ্রাম সিটিতে কোনো সাধারণ ছুটি থাকছে না। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উৎসবের পাশাপাশি শঙ্কাও দেখছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কার কথা চিঠি দিয়ে ইসিকে জানিয়েছেন অনেক প্রার্থী। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে সোমবার শঙ্কা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও। তিনি বলেছেন, ‘এই নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার শঙ্কা ও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নির্বাচন উপলক্ষে দুটি প্রাণহানি ঘটেছে। সহিংসতার আশঙ্কা থেকেই যায়। এ নির্বাচন ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকা অপরিহার্য, নইলে তা ভুল হয়ে যাবে।’ ইসির কর্মকর্তাদের মতে, ৩৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩২টিতেই আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। তারা বলছেন, বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সংঘাত হতে পারে।

প্রস্তুত ১১ হাজার ৭০০ ইভিএম : চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীলরা। ভোটের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১১ হাজার ৭০০টি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। এ সিটিতে মোট ভোটার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। ভোট কেন্দ্র ৭৩৫টি এবং ভোটকক্ষের সংখ্যা ৪ হাজার ৮৮৬। নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে মাঠে থাকছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রয়েছেন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। এ বিষয়ে রিটার্নিং অফিসার মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনী মালামাল পৌঁছে গেছে। সিটি নির্বাচনে ভোটাধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা থাকবে নগরী। ভোট নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। ৭৩৫ কেন্দ্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হচ্ছে ৪১৬টি। এর প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৮ জন সদস্য থাকবেন। আর সাধারণ কেন্দ্রে থাকবেন ১৬ জন। কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইসি জানিয়েছে, সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান দুই দলের দুই প্রার্থীসহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭ প্রার্থী। ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭২ জন ও ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫৭ জন কাউন্সিলর প্রার্থী। এবার নগরীর ৭৩৫টি কেন্দ্রের ৪ হাজার ৮৮৬টি বুথে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট হবে। ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন এবং মহিলা ভোটার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন।

জানা গেছে, ২০১০ সালের চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট দেন ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডের ভোটাররা। ২০১৫ সালের নির্দলীয় ভোটে একটি ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করে ইসি। এবারে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করবে ইসি। গত বছর ২৯ মার্চ ভোট গ্রহণের কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে ২১ মার্চ নির্বাচন স্থগিত করা হয়। সর্বশেষ আবারও ১৪ ডিসেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্থগিত হওয়া নির্বাচনে ভোট নেওয়ার নতুন তারিখ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

মেয়র প্রার্থীরা : চসিক নির্বাচনে এবার মেয়র পদে সাতজন লড়ছেন। এদের মধ্যে দুই হেভিওয়েট প্রার্থী হলেন- আওয়ামী লীগের মো. রেজাউল করিম চৌধুরী (নৌকা) ও বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন (ধানের শীষ)। অন্যদিকে ছোট চারটি দলের মধ্যে প্রার্থী রয়েছেন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ (চেয়ার), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম (হাতপাখা), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন (মোমবাতি) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আবুল মনজুর (আম)। অন্যজন হচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী (হাতি)। এবার নগরীর ১৪টি সংরক্ষিত এবং ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ছোট দলগুলোর কোনো কাউন্সিলর প্রার্থী নেই। চসিকের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীসহ ২৩৬ জন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া একজন কাউন্সিলর প্রার্থীর মৃত্যুতে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট স্থগিত রয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি এ ওয়ার্ডে ভোট হবে।

‘ভালো’ ভোটের আশায় ইসি : চট্টগ্রাম সিটিতে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের আগের দিন ঢাকায় গতকাল কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সর্বশেষ বক্তব্য সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন। এই নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের পাশাপাশি সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ। আমরা আশা করি, একটা সুষ্ঠু এবং প্রতিযোগিতামূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য যা যা উদ্যোগ নেওয়া দরকার তা নেওয়া হয়েছে। আশা করি একটা ভালো নির্বাচন দেখবেন।’ নির্বাচনী প্রচারণায় বেশ কয়েকবার সংঘাতের প্রেক্ষাপটে সহিংসতা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও এখন তা নেই বলে জানান সচিব। এক প্রশ্নে সচিব মো. আলমগীর বলেন, ‘এ নির্বাচনে অনেক দল অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেওয়া। সবার জন্য সমান সুযোগ করে দেওয়া, যাতে ভোটাররা ভোট দিতে আসতে পারেন, ভোট দিতে পারেন, কেউ যাতে বাধা না দেয়। সে জন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাখা হয়েছে। এটাই সবার জন্য সমান সুযোগ।’

মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড ৪১। এর মধ্যে একটি ওয়ার্ডে একজন কাউন্সিলর প্রার্থী মারা যাওয়ায় ভোট স্থগিত। আরেকটি ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনের দিন চট্টগ্রাম সিটিতে কোনো সাধারণ ছুটি থাকছে না।

যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন গণপরিবহন চলাচলে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় গতকাল মধ্যরাত থেকে আজ মধ্যরাত পর্যন্ত বেশ কিছু যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে ট্রাক, পিকআপ, বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা/ইজিবাইক, মাইক্রোবাস, কার ও জিপ। সেই সঙ্গে সোমবার মধ্যরাত থেকে আগামীকাল ভোর ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

তবে রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী/তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষকদের (পরিচয়পত্র থাকতে হবে) ক্ষেত্রে এ বিধি শিথিলযোগ্য। এ ছাড়া নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত দেশি/বিদেশি সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনে বৈধ পরিদর্শক এবং অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ কার্যক্রম ব্যবহারের জন্য যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর