সোমবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ফ্লাইওভার বানানোয় আগ্রহ তদারকির খবর নেই

অধিকাংশ ফ্লাইওভারে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ - রাতে জ্বলে না বাতি, লাইট স্ট্যান্ড ভাঙা, ময়লা আবর্জনায় বেহাল - চুরি ছিনতাইসহ হত্যাকান্ডও অন্ধকার ফ্লাইওভারে

মাহমুদ আজহার ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

ফ্লাইওভার বানানোয় আগ্রহ তদারকির খবর নেই

রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারে অনেক বাতি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। রাতে সৃষ্টি হয় ভুতুড়ে পরিবেশের। ঘটে ছিনতাই খুনসহ নানা অপরাধ -জয়ীতা রায়

শনিবার সন্ধ্যা ৭টা। রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের খিলক্ষেত প্রান্ত থেকে সারি সারি গাড়ি পূর্বাচল ও কুড়িল প্রান্তে নামছে। ফ্লাইওভারের সড়কবাতি জ্বলছে না, এমনকি সড়কবাতির স্ট্যান্ডও নেই। ভুতুড়ে পরিবেশ। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখা যায়, ফ্লাইওভারের দুই পাশে ধুলাবালি ও ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। একই অবস্থা মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারেও। এ ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অঘোষিত বাস, অটোস্ট্যান্ড। মাঝেমধ্যেই অন্ধকারে ঘটছে দুর্ঘটনা, চুরি, ছিনতাই। বাড়ছে ঝুঁকি। মহাখালী, মিরপুর ফ্লাইওভারেও ধুলাবালি আর আবর্জনার স্তূপ জমে আছে।

রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় ফ্লাইওভার তৈরিতে অনেক আগ্রহ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণে নজর নেই কোনো সংস্থার। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কার তা নিয়েও রয়েছে টানাপোড়েন। সংস্থাগুলোর টানাটানিতে প্রচুর অর্থ খরচ করে তৈরি করা ফ্লাইওভারগুলোর বেহাল দশা।

নগর বিশ্লেষক ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্লাইওভার ভেঙে ফেলা হচ্ছে আর আমাদের দেশে মহাউৎসাহে চলছে নতুন ফ্লাইওভার বানানো। কোন সংস্থা ফ্লাইওভার বানাবে তা নিয়ে দরকষাকষি চললেও রক্ষণাবেক্ষণে নেই আগ্রহ। এ জন্য চালুর কিছু দিনের মধ্যেই জীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে ফ্লাইওভারগুলো। নগর সরকার গঠন করে মেয়রকে এসব বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এতে সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা তৈরি হয়।’ রাজধানীতে যানজট নিরসনসহ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়নের জন্য পাঁচটি ফ্লাইওভার এবং দুটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। ফ্লাইওভারগুলো হলো- মহাখালী ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভার। দুটি ওভারপাস হলো- বনানী এবং বিজয় সরণিতে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ফ্লাইওভারগুলো। সড়কবাতি, সিগন্যাল নষ্ট, নোংরা জমে ফ্লাইওভারের মুখে জমছে হাঁটু পানি। নজরদারি না থাকায় ফ্লাইওভারে ঘটছে ছিনতাই, হত্যার মতো ঘটনা। সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সব ফ্লাইওভার না থাকায় নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়া হয় না ফ্লাইওভারগুলো। মালিবাগ ফ্লাইওভারের কিছু অংশ উত্তর সিটি করপোরেশনে বাকি অংশ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায়। পরবর্তীতে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু এ ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণে নজর নেই তাদের।

মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের   জায়গা দখল করে দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে চলছে সিন্ডিকেট বাণিজ্য। রাজারবাগ স্কুলের সামনে গড়ে তোলা হয়েছে লেগুনা স্ট্যান্ড ও মোটরসাইকেল পার্কিং। এ ছাড়া সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলের সামনে থেকে মৌচাক মার্কেট পর্যন্ত গাড়ির পার্কিং। নিউ ইস্কাটনের সড়ক ও ফুটপাথ অনেকটাই গাড়ি ব্যবসায়ীদের দখলে। মগবাজার থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচে অস্থায়ী গাড়ির গ্যারেজ বানানো হয়েছে। অনেক জায়গায় আবার দিনে-রাতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। শান্তিনগর বাজারের সামনে ফ্লাইওভারের নিচের অংশ রয়েছে ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীদের দখলে।   

সাইদ আহমদ নামে এক মোটরসাইকেল চালক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে সন্ধ্যার পর ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। চারদিকে অন্ধকার থাকে। ফ্লাইওভারে উঠতে ভয় লাগে।’

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর নির্মিত ফ্লাইওভারটি ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর চালু হয়েছে। মগবাজার, তেজগাঁও এবং চৌধুরীপাড়া-মালিবাগ-শান্তিনগর-রাজারবাগ ফ্লাইওভারে সড়কবাতি না জ্বলায় গভীর রাতে ফ্লাইওভারের ওপরে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। মাঝেমধ্যেই গভীর রাতে অন্ধকার ফ্লাইওভারের ওপর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। কিছু দিন আগে এই ফ্লাইওভারে মিলন নামে এক রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের চালককে খুন করে তার বাইক নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। রাতে ফ্লাইওভারে টহল পুলিশও থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে চলাচলকারীদের।

ফ্লাইওভারের মৌচাক-মালিবাগ অংশের সিগন্যাল বাতিও কাজ করছে না। ফ্লাইওভারের ওপরে ধূলাবালি, ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। বিভিন্ন জায়গায় পিচ উঠে তৈরি হচ্ছে গর্ত। সামান্য বৃষ্টিতেই ফ্লাইওভারের ওপরে পানি জমে থাকে। মহাখালী এবং মিরপুর ফ্লাইওভারের মুখে বৃষ্টি হলেই পানি জমে। ফ্লাইওভারগুলোর মুখে বাস থামিয়ে চলে যাত্রী ওঠানামা। এতে দ্রুতগতির গাড়িগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে।

গতকাল মহাখালী ফ্লাইওভারের জাহাঙ্গীর গেট প্রান্তে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট পরিবহন, বিকাশ পরিবহনের বাস থামিয়ে যাত্রী তুলতে দেখা যায়। এ রুটের অন্য বাস যেন তাদের আগে যেতে না পারে এ জন্য একপাশে না থামিয়ে রাস্তার মাঝে আড়াআড়ি করে রাখা হয়। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, দ্রুতগতির গাড়ি ব্রেক কষতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। ধুলা, আবর্জনাতে জরাজীর্ণ অবস্থা মিরপুর ফ্লাইওভারের। রাতে ধুলায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চারপাশ। এ ব্যাপারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী (প্রজেক্ট অ্যান্ড ডিজাইন) এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কুড়িল ফ্লাইওভারটি সড়ক ও জনপদকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলমান। আমাদের ফ্লাইওভার রক্ষণাবেক্ষণের কোনো খাত নেই। বরাদ্দ না থাকায় এসব ফ্লাইওভার তৈরির পর রাজউক রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না।’ কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে চায়ের দোকান। পূর্বাচল প্রান্তে ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে অঘোষিত বাসস্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে ভিক্টর ক্ল্যাসিক পরিবহন। সারা দিনই সেখানে চলে গাড়ি ধোয়া, মোছা ও মেরামতের কাজ। এ ছাড়া পিকআপও রাখা হয়। পুরো ফ্লাইওভারে সড়কবাতি রয়েছে হাতেগোনা। বাতির পাশাপাশি গায়েব হয়ে গেছে স্ট্যান্ডও।

জানা যায়, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফ্লাইওভার উদ্বোধন করেন। সে সময় এটি ছিল দৃষ্টিনন্দন ফ্লাইওভার। সাত বছরের মাথায় সব নান্দনিকতা হারিয়ে এটি এখন জীর্ণশীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ৩০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন দশমিক এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করে। ফ্লাইওভারটি নির্মাণে কুড়িল এলাকায় বিমানবন্দর সড়কের রেলক্রসিংয়ের ভয়াবহ যানজট দূর হয়। কিন্তু নির্মাণের পর থেকেই কোনো তদারকি নেই ফ্লাইওভারটির। এ রুটে চলাচলকারী রাইদা পরিবহনের চালক মোরশেদুল ইসলাম বলেন, সন্ধ্যার পরে এই ফ্লাইওভারে চলাচল করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। পুরো ফ্লাইওভারে সড়কবাতি জ্বলে না। ধুলা আর কুয়াশার কারণে হেডলাইট জ্বালিয়েও কিছু দেখা যায় না। দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে। আর সকালে খিলক্ষেত প্রান্ত থেকে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে ভ্যান রিকশায় নিয়ে যাওয়া হয় সবজি। ধীরগতির যানবাহনে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরের অংশ পরিচ্ছন্ন থাকলেও নিচের অনেক জায়গায় বেহাল অবস্থা। শনিরআখড়া থেকে নিমতলী পর্যন্ত নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবৈধভাবে দখল হয়ে আছে। উড়ালসড়কের নিচে প্রায় দুই শতাধিক অস্থায়ী দোকান রয়েছে। আছে ভাতের হোটেলও। যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ। গুলিস্তানের অংশে নিয়মিত বসে জুতার দোকানের পসরা। শনিরআখড়া-যাত্রাবাড়ী অংশ বিভিন্ন ফলের দোকান, রিকশা ও ভ্যানের স্ট্যান্ড আর চায়ের দোকানের দখলে। পুরনো প্যাকিং বাক্স, ডাবের খোসা, পলিথিনের স্তর ঢেকে ফেলেছে নিচের বিভাজকের মেঝে। এসব দখলদারিত্বকে অবৈধ বললেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নগর কর্তৃপক্ষ। নিমতলীর বাসিন্দা মোবারক হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানালেন, হানিফ ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচল করাই দায়। দিনের পর দিন নোংরা ময়লা-আবর্জনায় স্তূপ হয়ে থাকলেও দেখার কেউই নেই। আসলে ফ্লাইওভার কে দেখভাল করে তাও জনগণ জানে না। নগরবিদ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীর ফ্লাইওভার যারা বানান, তাদেরই দায়িত্ব কে এই ফ্লাইওভারগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করলে এর দায় তাদের নিতে হবে। ফ্লাইওভার নির্মাণে একটি সমন্বিত উদ্যোগ থাকা দরকার। কারণ, এখানে প্রচুর বিনিয়োগ হয়। মালিবাগ ফ্লাইওভার মূল পরিকল্পনায় ছিল না। কে বা কারা প্রভাব বিস্তার করে এই ফ্লাইওভার করল। এটা প্রয়োজন ছিল কি না তাও অনেকের প্রশ্ন।’

সর্বশেষ খবর