মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

আইনি দুর্বলতায় পার পেয়ে যাচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি

অনুবাদে আটকে আছে দেউলিয়া আইন

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

আইনি দুর্বলতায় পার পেয়ে যাচ্ছেন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনগুলোতে তাদের আটকানো যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যাংকঋণ গ্রহণকারীদের

আটকাতে সরকার দেউলিয়া আইন শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন শোনা যাচ্ছে, ওই আইনটি বাংলায় করতে গিয়ে অনুবাদের কারণে আটকে আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে টাকা পাচার করে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নামে-বেনামে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেরাই ঋণ নিয়ে গ্রাহকের শত শত কোটি টাকার আমানত ঝুঁকিতে ফেলছেন কেউ কেউ। আইনের দুর্বলতার কারণে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। কিন্তু টাকা ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। আবার প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও আইনি জটিলতায় আটকে থাকছেন বছরের পর বছর। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে আর্থিক খাতে সুশাসন কায়েম করার জন্য দ্রুত দেউলিয়া আইনটির সংশোধন প্রয়োজন।

দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, বাংলাদেশে দেউলিয়া আইন থাকলেও কেউ এর সুযোগ নিতে চান না। অনেক প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে যায় তবু নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে না। আবার আইনি দুর্বলতার কারণে দেউলিয়া ঘোষণার আগে কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদনের মাধ্যমে পুনর্গঠন সুবিধাও নিতে পারে না।

এ পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতে সুশাসন আনতে বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক ও আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে দেউলিয়া আইন সংশোধনের ঘোষণা দেন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও দেউলিয়া আইন সংশোধন করতে অর্থমন্ত্রীকে লিখিত সুপারিশ করেন। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক-আইএফসির পক্ষ থেকেও এই আইনটি দ্রুত সংশোধনের বিষয়ে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার যত দ্রুত আইনটি সংশোধন করতে চাইছে, তত দ্রুত সেটি হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান সরকারের সব আইন বাংলায় করার নির্দেশনা রয়েছে। যেহেতু দেউলিয়া আইনটি সংশোধন হচ্ছে, সে কারণে এটি বাংলায় করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর আগের আইনটির অনুকরণে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) দেউলিয়া আইনের একটি অনুবাদ করেছে। তবে সেটি সরকারের মনঃপূত হচ্ছে না। অনুবাদ পর্যালোচনা করে কিছু ক্ষেত্রে অসংগতি পাওয়া গেছে। ফলে নতুন করে অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, দেউলিয়া আইনে দুর্বলতার কারণে বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস বা ব্যবসা সহজীকরণ সূচকেও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও আইনটি সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে। এমনকি বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে ১১টি ইস্যুকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সংস্কারের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, এর মধ্যে এই দেউলিয়া আইন সংশোধনের বিষয়টি রয়েছে।

বিডার কর্মকর্তারা জানান, দেউলিয়া আইনের সংস্কার নিয়ে ২৫ আগস্ট তারা একটি সভা করেছেন। সভায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান উভয়েই ভারতের দেউলিয়া আইনের অনুসরণে দেশের আইনটি দ্রুত সংশোধনের পরামর্শ দেন।

সভায় সালমান ফজলুর রহমান বলেন, ‘দেউলিয়া বিষয়ক আইন, ১৯৯৭ সংশোধনে ভারতের গৃহীত পদক্ষেপ অনুসরণ করা যেতে পারে। ভারতের আইনের সঙ্গে আমাদের আইনে যতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, ততটুকু প্রাথমিকভাবে সংযুক্ত করা যেতে পারে।’ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘ভারতের দেউলিয়া বিষয়ক আইন ও আমাদের প্রণীত খসড়া আইনের মধ্যে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা চিত্র তৈরি করা প্রয়োজন, যা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে সংশোধন করার জায়গা চিহ্নিত করা যাবে।’

যত দুর্বলতা দেউলিয়া আইনে : দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রচলিত দেউলিয়া আইন ততটা কার্যকর নয়, যতটা কার্যকর অর্থঋণ আদালত আইন। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে এবং খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশে অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ কার্যকর রয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে এ আইনটির যথেষ্ট প্রয়োগ ও কার্যকারিতা থাকলেও দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭-এর কার্যকারিতা অনুরূপ নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও বলেছিল, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাওনাদারদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেউলিয়া আইনের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। অর্থঋণ আদালত কর্তৃক দেওয়া চূড়ান্ত রায়/ডিক্রির আদেশ দেওয়ার পর ঋণদায় পরিশোধের যে সময় আদালত দিয়ে থাকে (সাধারণত ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধের আদেশ দেওয়া হয়), ওই সময়ের মধ্যে কোনো দেনাদার অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে অর্থঋণ আদালত দেউলিয়া আদালতে ওই রায়/ডিক্রির একটি কপি পাঠাতে পারে, যাতে কপি পাওয়ার পর দেউলিয়া আদালতের বিচারক দেউলিয়া দেনাদারকে দেউলিয়া ঘোষণার সুযোগ পান।

সর্বশেষ খবর