বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মুদ্রাদোষেই ধরা খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

মুদ্রাদোষেই ধরা খুনি

রাত তখন সাড়ে ১১টা। গ্রামের মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু গ্রামের একটি খোলা মাঠে ফাঁদে পড়ে আছে মালা। প্রাণ বাঁচাতে মালা  দৌড়াচ্ছে। পেছন থেকে জাপটে ধরে ফেলেছে হারুন। হারুনের সঙ্গে আছে বুলেট আর জুয়েল। তারা মালার মুখ চেপে ধরে। চ্যাংদোলা করে নিয়ে যায় নির্জন একটি পুকুরপাড়ে। হারুন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। মালার জবাব, ‘আমি রাজি না’। ক্ষুব্ধ হয় হারুন। দেরি করেনি। মালাকে সেখানেই তিনজনে মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। চিৎকার করায় তার মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। রক্তাক্ত মালা তখন ছটফট করছে। এক পর্যায়ে মালা বলতে থাকে, ‘আমি সবাইকে বলে দেব। থানা পুলিশ করব। কাউকে ছাড়ব না।’ এ কথা শুনে হারুনের মাথায় যেন রক্ত উঠে যায়। আরও ক্ষুব্ধ হয়। শিমুল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে মালাকে বেঁধে ফেলে। এরপর মালার শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেয়। মালা তখন বাঁচার জন্য আকুতি-মিনতি করতে থাকে। কিন্তু পাষ-দের মন নরম হয়নি। মালার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে মালার তখন গগনবিদারী চিৎকার। আশপাশের লোকজনের কানে পৌঁছে যায় তার সেই আর্তনাদ। ছুটে আসে লোকজন, আসে মালার বাবা। ততক্ষণে লাপাত্তা তিন ধর্ষক। মালাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু পরদিন মারা যায় মালা। শুধু হারুনের কথাই বলতে পেরেছিল মালা। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রংপুরের পালিচরা গ্রামে মধ্যযুগীয় কায়দায় ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা করা হয় মালাকে। তার বাবা দিনমজুর মজিবর রহমান বাদী হয়ে সদর থানায় সাতজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করে।

পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। পুলিশ জানতে পারে এ ঘটনার সঙ্গে মালার বান্ধবী মুন্নি জড়িত রয়েছে। ঘটনার রাতে মালা তার বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। মুন্নির বাসায় যাওয়ার আগে মালা তার বাবা-মাকে বলেছিল। পুলিশ গ্রেফতার করে মুন্নিকে। জেরা শুরু। কিন্তু মুন্নি তার বান্ধবী মালাকে চেনেই না বলে দাবি করে। কিন্তু জেরার মুখে আর কতক্ষণ অস্বীকার করে থাকবে মেয়েটি। যখন বলা হলো, স্বীকার করলে তাকে মামলায় জড়াবে না, তখনই সব ফাঁস। ঘটনার আদ্যোপান্ত বলে দেয়। মুন্নি জানায়, হারুন তার খালাতো ভাই। তার অনুরোধ রাখতেই মালাকে সে তার বাসায় আসতে বলে। এখন পুলিশ খুঁজতে থাকে হারুন, বুলেট আর জুয়েলকে। কিন্তু ওরা লাপাত্তা। পাওয়া যায় না কোথাও।

পুলিশ হারুন বা অন্য খুনিদের চেহারাও চেনে না। বিভিন্ন জায়গায় সোর্স নিয়োগ করে পুলিশ। বেশ কিছুদিন পর পুলিশের কাছে খবর আসে, হারুনকে দেখা গেছে পাশের একটি গ্রামের বাজারে। সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছে হারুন। পুলিশ ছুটে যায়। কিন্তু কে হারুন! বিরাট একটা দ্বন্দ্বে পড়ে পুলিশ। কাকে ধরবে? অনেক লোকজন সেখানে। চেহারার সঙ্গে মিল পাচ্ছে না কারও। এক সোর্স খবর দিল, হারুনের একটা মুদ্রা দোষ আছে। একটু পর পর ডানদিকে মাথা ঝাঁকায়। পুলিশ তীক্ষè নজরে দেখছে। হোটেলের একটা চেয়ারে বসা যুবকের দিকে লক্ষ্য করে। সন্দেহ হলেও এই যুবকের দাড়ি-গোঁফ আছে। কিন্তু হারুনের তা ছিল না। পুলিশের চোখ ঘুরছে। হঠাৎ চোখ আটকে গেল একজনের দিকে। যুবকটি মাথা ডানদিকে ঝাঁকাচ্ছে! পুলিশ তখন উত্তেজনায়। আরে এই তো শিকার! যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় পুলিশের দল। চল, আর খেতে হবে না। খেয়েছিস অনেক। দাড়ি-গোঁফ রেখেছিস, তোর মুদ্রা দোষ পাল্টাতে পারিসনি। যুবকটি চেয়ার থেকে উঠতে চায় না। কিন্তু হ্যান্ডকাফ পরিয়ে যখন তাকে টানতে শুরু করল, তখন যেন যুবকটির আর তর সয়নি। নিজে থেকেই গাড়িতে বসল। এরপর সোজা থানায়।

থানায় নিয়ে শুরু হলো জেরা। হারুনকে সামনে রেখে পুরো ঘটনা ছোটদের নামতার মতো বলে যায় পুলিশ। আঁতকে উঠে হারুন। পুলিশ সব জেনে ফেলেছে! অস্বীকার করার আর কোনো পথ থাকে না। তার দেওয়া তথ্যে পাওয়া যায় আরেক খুনি বুলেটকে। কিন্তু অধরা জুয়েল।

২০০২ সালের অক্টোবরে রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন আদালত এই তিনজনের ফাঁসির আদেশ দেন। আর মুন্নিকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দন্ড।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর