বুধবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষার শক্তি অনেক বেশি

হেলাল হাফিজ

ভাষার শক্তি অনেক বেশি

একটা জাতির শিল্প-সংস্কৃতির মূল উপাদান ভাষা। এর শক্তি অনেক বেশি। এই শক্তিটাই শেষ করে দিতে চেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। আরেকটু সময় পেলে হয়তো তারা সফলও হতো। কিন্তু বাঙালি জাতি সেই ষড়যন্ত্র সফল হতে দেয়নি। মাতৃভাষার ওপর আঘাত বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিহত করেছে। জিন্নাহ যখন ঢাকায় এসে বললেন, ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’, গর্জে উঠল এ ভূখন্ডের মানুষ। প্রচন্ড আন্দোলন শুরু হলো। শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। গুলি হলো। রাজপথে লুটিয়ে পড়লেন অনেক ছাত্র। শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা ফিরে পেলাম মায়ের ভাষা। পাকিস্তানের গণপরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল বাংলা।

বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই স্বাধীনতা অনেক ত্যাগের ফসল। স্বাধীনতার জন্য ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এবং নেতৃত্বে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ বিনা বাক্যব্যয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই যে স্বাধীনতা যুদ্ধ, এর বীজতলা ছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের রক্তস্নাত পথ ধরেই পরবর্তীতে তৈরি হয় একের পর এক আন্দোলন। শিক্ষা আন্দোলন। শেখ মুজিবের ছয় দফা আন্দোলন। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধ। পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতা আমাদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। পাকিস্তান আমলেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিপক্ষে একটা প্রতিপক্ষ তৈরি হচ্ছিল। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত এখনো চলছে। সেখানে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। অন্য কোনো ভাষা যেন আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ না করে। আমরা যেন আমাদের ভাষাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন করি। একটা সুন্দর, মার্জিত, রুচিসম্পন্ন প্রমিত ভাষা যেন তৈরি হয় আমাদের। ভাষা নিজে তো নির্বাক। মানুষ এটাকে ব্যবহার করে সচল রাখে। আমাদের দায়িত্ব এই ভাষাটাকে প্রাঞ্জল করা, আরও শক্তি দান করা। আমাদের সাহিত্য, গান, কবিতা, উপন্যাসের মাধ্যমে সেটা করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনে করতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি। বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো ভালো লেখা আছে। সেগুলো বিশ্ব দরবারে আমরা পৌঁছাতে পারছি না শুধু ভাষাটা বাংলা বলে। এ জন্য আমাদের মানসম্মত সাহিত্যগুলোকে একাধিক বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। এটা বাংলা একাডেমি করতে পারে। অনুবাদের জন্য আলাদা একটা একাডেমি হতে পারে। অন্যথায় আমরা যত ভালোই লিখি না কেন, তা বিশ্ব দরবারে পৌঁছাবে না। পাশাপাশি পৃথিবীর অন্য ভাষার উন্নত সাহিত্যকর্মকেও আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। শুধু এ কাজের জন্যই একটা একাডেমি প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, দেশ ভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, এই ভূখন্ডের বাংলাভাষী মানুষের সকীয়তা, ভাষা, সংস্কৃতিকে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। একটা জাতিকে নিষ্ক্রিয় করতে প্রথম প্রয়োজন তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভেঙে দেওয়া। শিক্ষা ব্যবস্থাকে তছনছ করে দেওয়া। ভাষাকে শেষ করে দেওয়া। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সেটাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। কষ্টের জায়গাটা হলো- ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার এত বছর পর শিল্প-সাহিত্য ও ভাষার উৎকর্ষ সাধনে আমাদের যতদূর যাওয়ার কথা ছিল, সেটা পারিনি। এখন সামনে তাকানোর সময়। পৃথিবীর মানুষ যাতে আমাদের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয় এ জন্য নিজেদের তৈরি হতে হবে। এ জাতিকে সুসংগঠিত করে সুসংস্কৃতির চর্চা আরও বাড়িয়ে কীভাবে একে আরও উন্নত করা যায় সেটা ভাবতে হবে। ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য- এগুলোকে আরও উন্নত করতে কাজ করতে হবে সবাইকে। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান এগুলোর দায়িত্বে আছে, যেমন বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, সংবাদপত্র, শিক্ষকসমাজ, ছাত্রসমাজ, কবি, সাহিত্যিক- সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। আমাদের এতবড় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো কালজয়ী সাহিত্য কর্ম বা শিল্পকর্ম আজও আমরা রচনা করতে পারিনি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এই জনগোষ্ঠীর জন্য রুচিসম্মত সংস্কৃতির জোগান দেওয়া, তাদেরকে সুশিক্ষিত করে তোলা- এই কাজগুলো আমরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে করতে পারছি না। অনেক সময় চলে গেছে। আমাদের হাতে সময়ও খুব কম। জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। যা করার দ্রুত করতে হবে। লেখক : কবি।  অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর