রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে দায়সারা বিএনপি

অসুখে-বিসুখে শরীর ভালো নেই, কারাগারে যাওয়ার তিন বছর আগামীকাল

মাহমুদ আজহার

খালেদা জিয়াকে নিয়ে দায়সারা বিএনপি

কারাগারে যাওয়ার পর গত তিন বছর দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে একরকম ‘দায়সারা’ কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। মাঠপর্যায়ের নেতাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অনেকটা কাগুজে কর্মসূচিতেই ছিল দলটি। তৃণমূলের ক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা বলছেন, ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় ‘ঢাউস’ কমিটির নেতারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। বেগম জিয়াকে নিয়ে ভাবনা নেই তাদের। আবার আইনি লড়াইয়েও সফলতার মুখ দেখেননি দল সমর্থিত আইনজীবীরা। বেগম জিয়ার ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, তাঁর জামিন নিয়ে দলের আইনজীবীদের ভূমিকায়ও বিভিন্ন সময় তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ আছে, বেগম জিয়ার জামিনের চেয়ে আদালতপাড়ায় নিজেদের শোডাউনকেই বেশি গুরুত্ব দেন দলের আইনজীবীরা।

অসুখে-বিসুখে গুলশান এভিনিউর ‘ফিরোজা’য় এখন একান্তেই সময় কাটছে বয়োবৃদ্ধ বেগম খালেদা জিয়ার। রাজনীতির বাইরে থাকা বিএনপিপ্রধানের সময় কাটে পত্রপত্রিকা ও টিভির খবরাখবর দেখে। সময়-সুযোগে লন্ডনে থাকা পুত্র তারেক রহমান, দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি কেবল চিকিৎসকরাই যেতে পারছেন ফিরোজায়। অতি জরুরি প্রয়োজনে দলের দু-এক জন নেতাকে মাঝেমধ্যে তিনি ডেকে পাঠান।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় কারাজীবন শুরু করেন খালেদা জিয়া। পরে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তাঁর সাজার রায় হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আরও ৩৪টি মামলা রয়েছে। ২৫ মাসের বেশি সময় কারাবন্দী থাকার পর চলতি বছরের ২৫ মার্চ খালেদা জিয়া করোনাকালে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘মানবিক বিবেচনায়’ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান। এরপর আরও এক দফা তাঁর জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। জামিনে মুক্তির পর থেকে তিনি ফিরোজায় রয়েছেন। বিএনপি বলছে, গুলশানে ভাড়া বাসায় থাকলেও কার্যত গৃহবন্দী বেগম খালেদা জিয়া। তাঁকে বিধিনিষেধের আওতায় রাখা হয়েছে। তবে বেগম জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে রাজপথে ধ্বংসাত্মক কোনো আন্দোলন কর্মসূচি দিতে তিনি নিজেই বারণ করেছেন। তাই তাঁর মুক্তি দাবিতে রাজপথের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ কর্মসূচি চলছে। আগামীকাল সোমবার তাঁর কারাগারে যাওয়ার তিন বছর পূর্তি। ঢাকা মহানগরীসহ দেশে সব জেলা ও মহানগরে কাল প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশ ও জাতির  জন্য দুর্ভাগ্য যে আজ তিন বছর ধরে গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দী। তাঁর মুক্তির জন্য আমরা আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দেশে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় তাঁর কারামুক্তিতে বিলম্ব হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমেই আমাদের দাবি আদায় করে ছাড়ব।’

বিএনপিসূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে আপাতত রাজপথের কঠোর কোনো কর্মসূচিতে যাচ্ছে না দলটি। করোনায় দীর্ঘদিন সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্থগিত থাকার পর দল গোছানোয় বিএনপির এখন মনোযোগ। অঙ্গসংগঠনের পাশাপাশি মূল দল বিএনপি ও মহানগর পর্যায়ের কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হলে এপ্রিলের মধ্যে ছোট পরিসরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হতে পারে। এরপর দল কঠোর কর্মসূচির দিকে যাবে। এর আগে সরকারবিরোধী ছোট-বড় দল নিয়ে বৃহত্তর মোর্চা তৈরির চেষ্টা করা হবে। এরপর সরকারবিরোধী বৃহত্তর কর্মসূচিতে যাওয়ার চিন্তা। বেগম জিয়ার মুক্তির পাশাপাশি নতুন নির্বাচনের দাবি নিয়ে রাজপথে সরব থাকবে বিএনপি। তবে মাঝেমধ্যেই ইস্যুভিত্তিক সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচি চলবে। এরই অংশ হিসেবে আগামীকাল সারা দেশে সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে চট্টগ্রাম মহানগরে ১৩ ফেব্রুয়ারি, বরিশালে ১৮ ফেব্রুয়ারি, খুলনায় ২৭ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহীতে ১ মার্চ, ঢাকা মহানগরী উত্তরে ৩ মার্চ আর দক্ষিণে ৪ মার্চ সমাবেশ কর্মসূচিও দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অভিযোগ, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতাদের তালিকা সংগ্রহ করছে। এ নিয়ে তারা প্রত্যেক নেতার প্রোফাইল তৈরি করছে। সারা দেশে একযোগে এ কাজ চলছে। ৩ ফেব্রুয়ারি এ কাজ শুরু হয়েছে, ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। বিএনপি নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখানোর পাশাপাশি যাতে আন্দোলন করতে রাজপথমুখী সরব না হন সে জন্যই সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এ কাজ করছে।

বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে স্থায়ী কমিটিসহ তৃণমূলের প্রায় ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কয়েক লাখ মামলা রয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী জেলে। অসংখ্য নেতা-কর্মী গুম-খুন। এখন নানা সংস্থা দিয়ে তালিকা সংগ্রহের নামে ভয়ভীতি দেখানো হবে ‘ব্যাঙের সর্দির’ মতো। এসব করে কোনো লাভ হবে না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গণতন্ত্রের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচির কোনো বিকল্প নেই। ফ্যাসিবাদি এ সরকারকে হঠাতে এখন আমরা দল গোছানোর কার্যক্রম শুরু করেছি। পাশাপাশি জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে সরকারবিরোধী সব দল-মতের ঐক্য চাই। অন্য কোনো পথ নয়, গণতান্ত্রিকভাবেই এ সরকারের পরিবর্তন চাই। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত করাই আমাদের লক্ষ্য।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, ‘তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বক্তব্য হলো আন্দোলন ছাড়া বেগম জিয়ার মুক্তি মিলবে না। করোনার কারণে এত দিন কোনো কর্মসূচি ছিল না। আমরা যদি বেগম জিয়ার মুক্তি চাই, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই সে জন্য আন্দোলনই আমাদের একমাত্র পথ। নরম কথা বা নরম কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায় করা যাবে না।’

এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কিছু দিন আগেও খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে সে উদ্যোগ স্থগিত আছে বলে জানা যায়। অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের জন্য সরকার ও পরিবারের সমঝোতার মাধ্যমে বেগম জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কূটনৈতিক মহলও এ নিয়ে উদ্যোগী হয়। সরকার অনুমতি দিলে ব্রিটিশ হাইকমিশন বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য ভিসা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন বলেছিলেন, সরকার অনুমতি দিলে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য তারা ব্রিটেন যেতে ভিসা দেবেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ জন্য ব্রিটিশ সরকার ও হাইকমিশনারকে ধন্যবাদও জানান। কিন্তু হঠাৎই এ প্রক্রিয়া থেমে যায়। এখন বিএনপি ও পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, টিকা এলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ এখনো কমেনি। লন্ডন ও বাংলাদেশের অবস্থার এখনো আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। এ জন্য বেগম জিয়া নিজেও লন্ডনে যেতে আগ্রহী নন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার বোন সেলিনা ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সেখানে কীভাবে পাঠাব? সেখানেও তো করোনার অবস্থা ভয়াবহ। দুই দেশের করোনা পরিস্থিতি ভালো হলেই দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো যায় কিনা চিন্তা করা হবে।’

বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের সিনিয়র সদস্য, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা আগের মতোই। ডায়াবেটিস এখনো ওঠানামা করে। আগে জয়েন্টে জয়েন্টে যে ব্যথা ছিল সেগুলো এখনো আছে। এখনো তিনি আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর