রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষার চর্চা হবে বহুমাত্রিক

আহমদ রফিক

ভাষার চর্চা হবে বহুমাত্রিক

মহান ভাষা আন্দোলনের শুরুটা ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে, যখন মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতারা বলতে থাকেন যে হবু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন জনাকয় বাঙালি মুসলমান দৈনিক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে। সাংবাদিক-লেখক আবদুল হক তাদের অন্যতম। এভাবে শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা উপলক্ষে বাঙালি-অবাঙালির বাদ-প্রতিবাদ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২-এর এই সময়ে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, আন্দোলন প্রধানত বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে। ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিল ছাত্ররা। কিন্তু বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছিল বলেই আন্দোলনটি সর্বাত্মক রূপ পেয়েছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিশেষ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল করলে পুলিশ গুলি করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিরাট মিছিল বের হয়। পুরান ঢাকায় মুসলিম লীগের যে জুবিলি প্রেস ছিল, বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীরা সেটি পুড়িয়ে দেয়। প্রেসটি পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত তারা ফায়ার ব্রিগেডকেও কাছে আসতে দেয়নি। এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল মানুষ। বায়ান্নর আন্দোলনে মৃত্যু আন্দোলনের চরিত্র বদল ঘটায়। ভাষাচেতনার বিস্তার ঘটে শুধু ছাত্রসমাজেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তান-চেতনার সঙ্গে ভাষাচেতনার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। পাকিস্তান সরকারের বাংলাবিরোধী একের পর এক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বাঙালিরা লড়াই করেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা রক্ষা পায়। মাতৃভাষার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার বীজ বপন হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাহাত্তরে নয়া সংবিধানমাফিক ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। কিন্তু যারা সংবিধান তৈরি করেছেন তারাই দাফতরিক কাজে বাংলা ত্যাগ করে ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করেছেন। যে চেতনায় বাংলা ভাষার দাবি পূরণ হয়েছে, সেই চেতনা বাঙালি পুরোপুরি ধারণ করছে না। বাংলা ভাষা বিস্তারে সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বায়নের প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করছে। ঔপনিবেশিক মানসিকতা, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে উচ্চ আদালত, উচ্চশিক্ষাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ হচ্ছে না। এর জন্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও জোরালোভাবে এগিয়ে আসছে না। ফলে তরুণ প্রজন্ম ইংরেজি ভাষার দিকে বেশি ঝুঁকছে। যে কারণে একুশের চেতনা আজ বিস্মৃত, অবহেলিত। শিক্ষিত শ্রেণি, সংস্কৃতিসেবী, রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান যাদের কথাই বলি না কেন কেউ কিন্তু একুশের চেতনা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছে না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, একুশের চেতনা এখন বিস্মৃত, অবহেলিত। শিক্ষিত ও ঔপনিবেশিক শ্রেণি যারা রাজভাষায়, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও অভ্যস্ত এবং যে শিক্ষিত শ্রেণি সমাজকে সচেতন করে থাকেন তারা ওই অভ্যস্তের পথ থেকে সরে আসতে পারছেন না। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা যেন ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক না হয়। বাংলা ভাষার ব্যবহার যারা টিকিয়ে রাখতে চান তাদের বায়ান্নর রক্তঝরা দিনকে স্মরণ করে, ভাষার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ভাষার চর্চাকে বাড়াতে হবে বহুমাত্রিকভাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর