মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বাজার ভরা ভেজাল চালে

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বাজার ভরা ভেজাল চালে

রাজধানীর চালের দোকানগুলো ভরে গেছে ভেজাল চালে। বাহারি নামে, আকর্ষণীয় বস্তায় যেসব চাল বিক্রি করা হয়, তার অধিকাংশতেই ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ক্রেতারা শুধু আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তাই নয়, প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি পালিশ করা, কৃত্রিম রং মেশানো ভেজাল চালের ভাত খাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখেও পড়ছেন। অন্যদিকে ভেজালের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত মিল মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে মিনিকেটের ভেজাল প্রচলিত। মোটা চাল পালিশ করে মিনিকেট নামে বিক্রি হয়। তবে বর্তমানে নাজিরশাইলসহ চিকন ও সরু চালের বস্তায় মোটাচাল ভরে নতুন ধরনের প্রতারণা শুরু হয়েছে। ভোক্তাদের পকেট থেকে চিকন বা সরু চালের টাকা নিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মূলত মোটা চাল। রাজধানীর মিরপুরের গৃহিণী সেলিনা নাজনীন জানান, তিনি নাজিরশাইল নামে ৫০ কেজির একটি চালের বস্তা কিনে আনার পর ভিতরে দেখেন ব্রি-২৮ জাতের চাল, যা বাজারে আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয় প্রতিবস্তা। ভেজাল চালে এভাবে প্রতারিত হওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে আহত হয়েছেন।

‘ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। বাড়ির ছোট থেকে বয়স্ক প্রতিটি সদস্যের প্রধান খাদ্য এটি। এই চালেও যদি ভেজাল হয় তবে কী খেয়ে বাঁচবে দেশের মানুষ?’- হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন রাখেন মিরপুরের এই গৃহিণী।   

চালের এই ভেজাল নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ যেসব তথ্য পেয়েছে, তাতে দায় নিচ্ছে না কেউ। মিল মালিকরা বলছেন, তারা ভালো মানের চাল বস্তায় ভরে আড়তে দেওয়ার পর, অসৎ ব্যবসায়ীরা দ্রুত সেই ব্র্যান্ডের বস্তার ছাপ নকল করে নিম্নমানের চাল আড়তে সরবরাহ করে। আড়তদাররা বলছেন, তারা মিল মালিকদের কাছ থেকে যে বস্তা পান খুচরা পর্যায়ে তাই সরবরাহ করেন। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা ভোক্তার কাছে বিক্রি ছাড়া চাল প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনোকিছুর সঙ্গেই জড়িত নয়, ফলে তাদের মাধ্যমে ভেজাল করার সুযোগ নেই। যখন মিল মালিক, আড়তদার, খুচরা বিক্রেতা কেউই চালের ভেজালের দায় নিচ্ছে না, তখন প্রশ্ন ওঠে ভেজালটা হচ্ছে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে বিস্ময়কর তথ্য।

কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুরের পর দেশের যেসব জেলা থেকে ভালোমানের চাল সরবরাহ হয়, তার মধ্যে শেরপুর অন্যতম। এই জেলায় রয়েছে অসংখ্য অটো রাইসমিল। এখানে তুলসীমালা, কালোজিরা, চিনিগুঁড়ার মতো সুগন্ধি চাল ছাড়াও ভালো মানের নাজিরশাইল চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। শেরপুরের নালিতাবাড়ির মেসার্স জয়লক্ষ্মী অটোরাইস মিল থেকে ‘জোড়া গাভী’ ব্র্যান্ডের নাজিরশাইল চাল সরবরাহ করা হয়, দেশে যার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার কারণে ওই ব্র্যান্ডের চালের বস্তা হুবহু নকল করে শেরপুর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের জেলা নরসিংদী থেকে ভেজাল চাল সরবরাহ করা হচ্ছে।

শেরপুরের মেসার্স জয়লক্ষ্মী অটোরাইস মিলের স্বত্বাধিকারী অসীম দত্ত হাবলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের জোড়া গাভী নাজিরশাইল চালের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অসৎ ব্যবসায়ীরা নরসিংদী থেকে একই ধরনের বস্তা নকল করে ভেজাল চাল সরবরাহ করছে। ফলে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন তাই নয়, মিল মালিক হিসেবে আমি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কারণ ভেজাল চাল কিনে প্রতারিত হওয়ার পর কেউ আর এই ব্র্যান্ডের চাল নিতে চাইবে না।

শেরপুরের জোড়া গাভী ব্র্যান্ডের নাজিরশাইল চাল সরসিংদীতে ভেজাল হলেও সেখানে উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে নালিতাবাড়ি, শেরপুরের নামই উল্লেখ রয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নামও এক। কেবল মালিকের নাম অসীম দত্ত হাবলুর স্থলে অসীম সাহা লেখা রয়েছে। চালের বস্তায় উল্লিখিত মোবাইল নম্বরে ফোন দেওয়ার পর বস্তা নকল করে ভেজাল চাল সরবরাহ করার বিষয়টি এক পর্যায়ে স্বীকার করেন সেই ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তার প্রকৃত নাম গৌতম, নরসিংদীতে তার প্রতিষ্ঠানের নাম সততা ভা-ার। কেবল ভালো ব্র্যান্ডের কারণে তিনি বস্তাটি নকল করে চাল সরবরাহ করছেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রশ্নের জবাবে গৌতম জানান, তিনি শুধু একা নন, সারা দেশেই এখন ভালো ব্র্যান্ডের নামে নকল বস্তায় নিম্নমানের চাল সরবরাহ করা হয়। তবে তিনি স্বীকার করেন, শেরপুরের প্রকৃত মালিক ফোন করার পর বস্তা নকল করে ওই কোম্পানির নামে চাল সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন।

ভেজাল বা নিম্নমানের চাল সরবরাহ প্রসঙ্গে নরসিংদীর এই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা যখন আশুগঞ্জ থেকে চাল সংগ্রহ করি, তখন জানতে চাওয়া হয় কোন নামে চালের বস্তা হবে। বাজারে যে ব্র্যান্ডের চাল ভালো, আমরা সেটির নাম বলে দেই। কম্পিউটারে ছাপ দিয়ে বস্তা  তৈরি করে ওই বস্তা ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুধু শেরপুরের জোড়া গাভী নয়, টাঙ্গাইলের সোনারবাংলাসহ দেশে ভালো ব্র্যান্ডের যত চাল আছে তার সব বস্তা নিমিষেই এভাবে নকল করে দেদার ভেজাল চাল বিক্রি করা হয় বলে জানান এই ব্যবসায়ী। 

দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। ওই কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোটা, মাঝারি মোটা বা লম্বা-মোটা চালকে কাটিং এবং পলিশ করে চিকন/সরু চালের দামে বিক্রয় করে ভোক্তা ঠকানো হচ্ছে যা নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর পঞ্চম অধ্যায়ে ৩১ ও ৩২ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম ভেজাল চালের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, খাদ্যে ভেজাল যে অপরাধ এটি জেনেও অনেকে এ ধরনের ভেজালের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, চালে ভেজালের কারণে ভোক্তা শুধু যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, প্রতারিত হওয়ার ফলে মানসিকভাবেও তিনি পর্যুদস্ত হচ্ছেন। উপরন্তু নিম্নমানের চাল ভোক্তার পরিবারে প্রতিটি সদস্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।

রেজাউল করিম জানান, তাদের আইনে যে কোনো ধরনের খাদ্য সেটি কোন জেলা থেকে উৎপাদিত হবে লেবেলে সেটি উল্লেখ করতে হবে। ফলে শেরপুরের চাল নরসিংদী থেকে শেরপুরের নামে সরবরাহ করাও অপরাধ।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এই সদস্য জানান, তারা যখনই সুস্পষ্ট অভিযোগ পাচ্ছেন, ত্বরিত ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তবে লোকবল এবং দক্ষতার অভাবে তারা সারা দেশে এ ধরনের ভেজাল প্রতিরোধে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে পারছেন না বলেও স্বীকার করেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর