বুধবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষা কি আদৌ টিকে থাকবে

মোহন রায়হান

বাংলা ভাষা কি আদৌ টিকে থাকবে

আমরাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে ‘মা’ ডাকের অধিকারের জন্য বুকের রক্ত দিতে হয়েছে। মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করতে হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ আর অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম। বড়ই দুর্ভাগ্য, পঞ্চাশ বছরের দুয়ারে এসে সেই দেশ আজ মধুর ‘মা’ ডাক থেকে বঞ্চিত!

কেন নতুন প্রজন্ম মম, ড্যাড, পাপা, আঙ্কেল, আন্টি এসব সম্বোধনে আনন্দ পায়? এই প্রজন্ম বাংলার বদলে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে গৌরব বোধ করে। বাংলা শিক্ষার চেয়ে ইংরেজি শিক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ছেলে-মেয়েরা মাতৃভাষার বদলে অপর ভাষায় পারদর্শী হওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। কারণ একটাই, ইংরেজিতে দক্ষ হলে জীবন-জীবিকার সুনিশ্চয়তা। মোক্ষম সফলতা। সফলতার মূল চাবিকাঠি যে জ্ঞান অর্জন, তা মাতৃভাষায় যত সহজ ভিন্ন ভাষায় তা কখনোই সম্ভব নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।’ নিধিরাম গুপ্ত বলেন- ‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা?’

মাতৃভাষায় শিক্ষার চেয়ে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দানের প্রতি অবিভাবকদের পক্ষপাত কারণ, শিক্ষা এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। এক সময় অবিভাবকেরা সন্তানকে সুশিক্ষিত এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতেন। টাকা কামানোর মেশিন বানানোর জন্য নয়। কিন্তু বিশ্ব-পুঁজিবাদী শোষণ, লুণ্ঠন, বৈষম্যের বিশ্বায়ন আর বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে দিচ্ছে মানুষের যাবতীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। এই বস্তুতান্ত্রিক, মানবতা-রহিত শিক্ষার পত্তন হচ্ছে খোদ পরিবার থেকেই। পরিবার মানুষের প্রথম শিক্ষালয়। মানবতার পচন শুরু হচ্ছে আজ নিজগৃহ থেকেই। ধনীকে আরও ধনী গরিবকে আরও গরিব বানানো আর মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার এই রাষ্ট্র গড়তেই কি আমরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম! বাণিজ্যনির্ভর প্রাইভেট স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা আজ পণ্যের মতন বিক্রি হচ্ছে। যার যত টাকা আছে সে তত দামি শিক্ষাপণ্য ক্রয় করতে পারছে। তার তত বেশি ঠাট, তত বেশি অহংকার।

অনুৎপাদনশীল উন্নয়নের মেগা প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের চেয়ে জরুরি ছিল, জাতিসংঘ ঘোষিত দেশের জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ৬ শতাংশ (বাংলাদেশে মাত্র ২%) শিক্ষা খাতে ব্যয় করে বৈষম্যহীন, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা আর জ্ঞানার্জনের পথ সুগম করা, জাতিকে প্রকৃত শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত করা, ছাত্র-ছাত্রীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা কোনো ভাষা-শিক্ষারই বিরোধী নই। বরং যুগে যুগে কালে কালে বহুভাষার সংমিশ্রণে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। যে কারণে বাংলা ভাষাকে মিশ্র বা শংকর ভাষা বলা হয়। গবেষণা কিংবা উচ্চতর ডিগ্রি লাভ, অন্য ভাষার বই পড়ার বা জ্ঞান চর্চার প্রয়োজনে যে কোনো বিদেশি ভাষা শিক্ষার জন্য অধিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যার কাজ হবে, বিদেশি শিল্প-সাহিত্য-দর্শন, ইতিহাসসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার বাংলা অনুবাদ। অনুরূপভাবে বাংলা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তর।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো’। ৬৯ বছরে কি সেটা চালু হয়েছে? শুধু কি সংবিধানে লেখা থাকলেই প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা হয়ে যায়? দেশে কোথাও কি নিরঙ্কুশ বাংলা ব্যবহার হচ্ছে? যে দেশের নাম বাংলাদেশ, যে জাতির নাম বাঙালি, সে দেশে কি আইন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা আর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে? নতুন প্রজন্ম কেন বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলছে? কেন এফএম রেডিও, টিভি নাটকে, সিনেমায় মাতৃভাষার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-ব্যঙ্গ ব্যবহার হচ্ছে? এ দায় কার?

তথ্য প্রযুক্তির এই চরম বিকাশের যুগে আমরা অবশ্যই তার যথার্থ ব্যবহার করে দেশ ও জনগণকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করব। কিন্তু তার অপব্যবহার করে নিশ্চয়ই নিজের ঘরেই বোমা বিস্ফোরণ করে আত্মঘাতী হব না। যেখানে খোদ বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়ার বিপক্ষে সেখানে আমাদের শিশু-কিশোরদের হাতে হাতে মোবাইল। বিজ্ঞান আজ আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে। তথ্য প্রযুক্তি আজ সারা পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশের দ্বার অবারিত করলেও, আমাদের নতুন প্রজন্ম জ্ঞানচর্চা, মেধা ও মননশীলতায় তা কতটা কাজে লাগাচ্ছে? নাকি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস দিন দিন আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-কৃষ্টিবিমুখ করে তুলছে? সচেতন মহলকে তা এখনই গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। দোর্দ- সংক্রামক অপসংস্কৃতির দানবীয় আমূল আগ্রাসন থেকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি কি পারবে অনাগত প্রজন্মকে রক্ষা করতে? অপসংস্কৃতির অশুভ প্রতাপের সামনে আর কত দিন টিকে থাকবে প্রাণের বাংলা ভাষা? লেখক : কবি।

সর্বশেষ খবর