শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

কাগুজে দল অস্তিত্বহীন ছাত্রসংগঠন

দেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৬০টি, বেশ কিছু দলের নেই ছাত্রসংগঠন

মাহমুদ আজহার ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

কাগুজে দল অস্তিত্বহীন ছাত্রসংগঠন

দেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত প্রায় ৬০টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনও আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই কাগুজে। বছরের পর বছর কমিটি নেই, কার্যক্রমও নেই। নেই দলীয় কার্যালয়। এসব সংগঠনের বড় অংশই বিবৃতি নির্ভর ও কাগুজে। এদের ছাত্রসংগঠনগুলোও অস্তিত্বহীন। বেশ কয়েকটি দলের ছাত্র সংগঠনই নেই। কিছু সংগঠনের নামে ছাত্র সংগঠন থাকলেও এগুলো কাগজে-কলমে। কোনো কোনো সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাধারণ সম্পাদক থাকলেও নেই কার্যক্রম। জেলা-মহানগর কিংবা উপজেলা পর্যায়ে প্রায় সব ছাত্র সংগঠনের কমিটি নেই। তবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বাইরে কয়েকটি বাম সংগঠন রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সক্রিয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের রাজনীতিই এখন নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকটা দুই দল নির্ভর রাজনীতি। জনকল্যাণের রাজনীতি এখন নেই। ক্ষমতায় যাওয়া ও ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থের রাজনীতি চলছে। তাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বাইরে কোনো রাজনৈতিক দলই তেমন সুবিধা করতে পারছে না। কেউ অন্য দলে সম্পৃক্ত হয়ে তেমন কোনো সুবিধাও করতে পারবে না। এখন সবাই আওয়ামী লীগ হতে মরিয়া। ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও একই অবস্থা। মূলত নিজের আখের গোছানোর জন্যই তারা সরকারি দলের কর্মী-সমর্থক হচ্ছেন। এ কারণেই অন্য দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই।

গণফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনের ২৫ নম্বর নিবন্ধিত দল। নামসর্বস্ব এ দলটির নেই কোনো ছাত্র সংগঠন। দলের কার্যক্রমও চোখে পড়ে না। এ প্রসঙ্গে গণফ্রন্ট চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ছাত্র সংগঠন রাখার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে বাধ্যবাধকতা নেই। আমি মনে করি ছাত্রদের লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। ছাত্রদের অনেক অবদান রয়েছে। তবে মূল দলের লেজুড়বৃত্তি করা উচিত নয়।

ডেমোক্রেটিক পার্টির (ডিএল) ছাত্র সংগঠনের নাম গণতান্ত্রিক ছাত্রলীগ। কাগজে-কলমে ইফতেখার করিম মামুন ও বিমল দাসের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের কমিটি আছে। কিন্তু বাস্তবে নেই কোনো কার্যক্রম। জেলা-উপজেলা তো দূরের কথা ঢাকায় নেই এর কমিটি। এ প্রসঙ্গে ডিএল সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন মনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের এই সংগঠনটি ’৯০ এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বেশ সক্রিয় ছিল। এরপর আর তেমন কার্যক্রম নেই। শুধু আমরা কেন, অনেক দলের ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন বিকল্প ছাত্রধারা। এ সংগঠনটির কমিটি বিলুপ্ত করা হয় ২০১৪ সালে। এরপর থেকেই সংগঠনের কোনো কমিটি নেই। বিকল্পধারা বাংলাদেশের সাবেক দফতর সম্পাদক মো. ওয়াসিমুল ইসলাম জানান, বর্তমানে বিকল্প ছাত্রধারার কমিটি নেই । তবে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, বিলুপ্ত করার আগে সংগঠনটির কার্যক্রম সক্রিয় ছিল।

প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি)। সম্প্রতি এ দলের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। এই দলের চেয়ারম্যান ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীও মারা গেছেন। এখন এই দলের কোনো ছাত্র সংগঠন নেই। ওয়ান ইলেভেনে একটি ছাত্র সংগঠন করার চেষ্টা করলেও পরবর্তীতে এর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না।

গনতন্ত্রী পার্টির ছাত্র সংগঠনের নাম জাতীয় ছাত্রঐক্য। রাজধানীতে তাদের কিছু কার্যক্রম দৃশ্যমান। বাইরে দুই একটি জেলাই কিছু কার্যক্রম থাকলেও সারা দেশেই অনুপস্থিত এই সংগঠন। কমিটিও নেই। গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ শিকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা আমাদের ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম সীমিত আকারে চলছে।

অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির ছাত্র সংগঠনের নাম গণতান্ত্রিক ছাত্র দল। মাঠ পর্যায়ে এর কোনো কার্যক্রম নেই। এ সংগঠনের সাবেক ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তমিজুদ্দিন টিটু জানান, সংগঠনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সমন্বয়কারী সংগঠন দিয়ে ছাত্র সংগঠন পরিচালনা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এম এল) ছাত্র সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনের সভাপতি ইউনুছ সিকদার জানান, কাগুজে তাদের ৩৮টি জেলায় কার্যক্রম থাকলেও সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি জেলায়।

সম্প্রতি নিবন্ধন বাতিল হয়েছে ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার। এই দলের সহযোগী সংগঠন জাগপা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমও চলছে ঢিমেতালে। ঢাকাসহ দেশের বাইরে কিছু কমিটি থাকলেও এগুলো কাগজে কলমে। এ সংগঠনটিরও দৃশ্যমান কর্মকান্ড চোখে পড়ে না। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র কল্যাণের সাংগঠনিক অবস্থা কাগজকলমে থাকলেও বাস্তবে বছরে শুধু প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়। দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম তেমন নেই। জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন ন্যাপের তেমন কার্যক্রম নেই। লেবার পার্টির (ইরান) ছাত্র মিশন মাঝেমধ্যে ইস্যুভিত্তিক কার্যক্রম করে। লেবার পাটির্র (মেহেদি) ছাত্র সংগঠনের একই অবস্থা।  

কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নাম ছাত্র ইউনিয়ন। গত বছরের ২২ নভেম্বর ফয়েজ উল্লাহকে সভাপতি ও দীপক শীলকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি  ঘোষণা করা হয়। ঢাকাসহ বিভাগীয় পর্যায়ে এই সংগঠনের কিছু কার্যক্রম দৃশ্যমান। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ সমর্থিত ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাসিরউদ্দিন প্রিন্স জানান, ৬০টি জেলায় তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। করোনাকালে বন্ধ থাকাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেতন আদায় বন্ধ, নারী নির্যাতন বন্ধসহ নানা দাবিতে সক্রিয় রয়েছেন তারা। বিভাগীয় সমাবেশের অংশ হিসেবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ব্যানারে কর্মসূচি রয়েছে বলে জানান তিনি। বৈষম্যহীন সমাজ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নির্মূল করার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে রয়েছে জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। আহসান হাবীব শামীমকে সভাপতি ও রাশিদুল হক ননীকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ)-এর কমিটি গঠন করা হয় ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি নাসিমুল হুদা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  দেশের উল্লেখযোগ্য ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রায় সবটির কার্যক্রম আছে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন ছাড়াও সক্রিয় আছে ভিপি নূরের ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইশা প্রভৃতি সংগঠন। তবে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন ‘জাতীয় ছাত্র সমাজ’ ডাকসু নির্বাচনের সময় সামনে আসার চেষ্টা করলেও বাম দলগুলোর প্রতিরোধে তা সম্ভব হয়নি। বরাবরের মতো ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে আধিপত্য ধরে রেখেছে। হলগুলোতেও তাদের শক্ত অবস্থান আছে। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণার পর বিভিন্ন সময়ে শূন্য হওয়া ৬৮টি পদ সম্প্রতি পূরণ করা হলেও এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখাগুলোর কমিটি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি সংগঠনটি। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ পায় ছাত্রদল। বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক রাকিবুল ইসলাম রাকিব এবং সদস্যসচিব আমান উল্লাহ আমানের নেতৃত্বে এখন নিয়মিতই ক্যাম্পাসে যাচ্ছে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।  কোটা আন্দোলনের জেরে জন্ম নিয়েছিল ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’। সংগঠনটির আংশিক একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিও আছে।

মধ্যমপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলো ছাড়াও অন্তর্দ্বন্দ্বের খবর বেশি শোনা যায় বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে। সম্প্রতি ছাত্র ইউনিয়নের ৪০তম সম্মেলনে গঠনতান্ত্রিক ব্যত্যয়ের অভিযোগ তুলে সংগঠনটির একাংশের নেতা-কর্মীরা আলাদা সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শোনা গিয়েছিল। সংগঠনের অভ্যন্তরে আদর্শিক ও নেতৃত্ব নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এখন তিনটি ধারায় বিভক্ত। ভেঙে যাওয়া অংশগুলো হলো সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী) এবং নতুন আত্মপ্রকাশ পাওয়া অংশ গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল। তবে রাজপথের আন্দোলনে অন্য বামপন্থি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে যাচ্ছে ছাত্র ফেডারেশন। সম্প্রতি নানা কর্মসূচিতে নিয়মিত দেখা যাচ্ছে জাসদ ছাত্রলীগকেও। এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনের সময় থেকে ক্যাম্পাসে সক্রিয় আছে ইসলামিক শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন-ইশা। তবে ‘শিবির করার অভিযোগে’ বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনা ঘটলেও প্রকাশ্যে কখনই কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়নি ইসলামী ছাত্রশিবিরকে।

সর্বশেষ খবর