শনিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

নতুন শ্রমবাজারে চ্যালেঞ্জ

দেশের বাজার ধরার চেষ্টা, বড় বিকল্প হতে পারে মালয়েশিয়া

জুলকার নাইন

নতুন শ্রমবাজারে চ্যালেঞ্জ

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি পর্যুদস্ত হলেও সেই মধ্যপ্রাচ্যেই আটকে আছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি। এর বাইরে অন্য দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকরা গেলেও তার হার অনেক কম। কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে তেল নির্ভর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের সুযোগ কমে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই কয়েক লাখ শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। নতুন করে যাদের যাওয়ার কথা ছিল সেই সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে নতুন শ্রমবাজার চালু করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি মালয়েশিয়ার মতো বড় বাজার দ্রুত পুনরায় চালু করাই হতে পারে একমাত্র বিকল্প বলছেন অভিবাসন খাতে ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা। শ্রমবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হঠাৎ করেই বড় ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। নতুন শ্রমবাজার তৈরি দূরের কথা পুরনো শ্রমবাজারেও শ্রমিক পাঠানো যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে আরব আমিরাতের শ্রমবাজার। ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ মালয়েশিয়ার বাজার। সৌদির শ্রমবাজার খোলা থাকলেও নানান কূটনৈতিক পথপরিক্রমায় তৈরি হয়েছে নানান অনিশ্চয়তা। এর মধ্যে বিভিন্ন দেশে কর্মহীন হাজার হাজার শ্রমিক। অনেক শ্রমিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে, এমনকি মেয়াদ শেষ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে আরও অনেকে। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি হিসাব মতে, গত ৮ মাসে বেকার হয়ে দেশে ফিরেছে প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক। আর নতুন ৭ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর টার্গেট থাকলেও পাঠানো গেছে মাত্র ২ লাখ শ্রমিক।

জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক শামসুল আলম বলেছেন, আগে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ হাজার লোক বিদেশে যেত। এখন তা কমে ১৬/১৭ শ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে তা দিন দিন কমছে। অনেক দেশ বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় এমন হচ্ছে। আসলে মহামারীর এ সময়ে কারও কিছু করার নেই। সবাই অসহায়। তিনি বলেন, গত ৮ মাসে যারা ফিরেছেন তার মধ্যে ৮/৯ হাজার লোক আবার ওইসব দেশে ফিরে গেছেন। আর বাকিরা সবাই এমনিতেই আর যেতে পারবেন না। তিনি বলেন, ফিরে আসাদের মধ্যে অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ, অনেকে প্রতারিত হয়ে ফিরেছেন, আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে অপরাধ করে সাধারণ ক্ষমায় ফিরেছেন। তারা আর যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। নতুন শ্রমবাজার সম্পর্কে বিএমইটি মহাপরিচালক বলেন, মালয়েশিয়া, উজবেকিস্তান ও জর্ডানের ব্যাপারে সরকার আশাবাদী। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে এর কাজের অগ্রগতি বোঝা যাবে। পাশাপাশি মধ্য এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়া এবং কাজাখস্তান। এ ছাড়াও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকংয়ের কথাও ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, মরুভূমির চেয়ে এসব দেশে আবহাওয়া সহনীয়। তাছাড়া এসব দেশে কাজগুলোর ধরন ভালো, শুধু ক্লিনারের কাজ নয়। বেতনও বেশি আবার শ্রমিকদের অধিকারের পরিস্থিতিও ভালো।

বেসরকারি সংস্থা রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকির মতে, বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ হতে পারে জাপান। কারণ ২০২৫ সাল পর্যন্ত জাপান সারা বিশ্ব থেকে ৫ লাখ কর্মী নেবে। বাংলাদেশকে এই বাজারটা ধরতে হবে। যারা জাপানিজ ভাষা জানবে ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তিনি জানান, গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ২ হাজারের মতো শ্রমিক বিদেশে কাজে গেছেন। তার মধ্যে ৮০০ মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে। সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের থেকে তারা বেশি বেতন পাচ্ছেন। তবে সেখানে যেতে হলে কমপক্ষে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা থাকতে হবে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, করোনাপরবর্তী আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদা অনুযায়ী পুনঃপ্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে ফেরত আসা কর্মীদের পুনরায় বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, বিরূপ পরিস্থিতিতে ঝুঁকি কমানোর জন্য ভবিষ্যতে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে। তিনি মনে করেন, বিদেশফেরত কর্মীরা অভিজ্ঞতার বিবেচনায় দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।

সংকট কাটাতে বড় বিকল্প মালয়েশিয়া : করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এ জন্য শ্রমবাজারের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি নিয়ে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাবও দিয়েছে মালয়েশিয়া। এই শ্রমবাজার চালু হলে মাত্র ছয় মাসেই ৪ লাখ শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালয়েশিয়ার আগ্রহের পরও বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলের নানান স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে শ্রমবাজার চালুর সিদ্ধান্ত। প্রশ্ন উঠেছে, শ্রমবাজার উন্মুক্ত করা নাকি বিভিন্ন মহলের স্বার্থরক্ষা কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সূত্র জানায়, দেশটির কৃষি ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৬ লাখ লোক পাঠানো যাবে। শ্রমিকরা ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে সেখানে যেতে পারবেন। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবমতে ২৫ অথবা ৩০ রিক্রুটিং এজেন্সিকে লাইসেন্স দিয়ে লোকবল নেওয়া হবে। মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে সরকারি পদ্ধতিতে জনশক্তি নেবে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এখানে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতেই সব হবে। এর আগে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে ১৮ মাসে প্রায় ২ লাখ কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। আগের মতো শ্রমিকদের অভিযোগ ছিল না, অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও খুশি ছিল তারা। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সোর্স কান্ট্রি হিসেবে মালয়েশিয়ায় মর্যাদা পেয়েছিল। শুধু তাই নয় মালয়েশিয়ার জিটুজি পদ্ধতি শুরুর আগে সৌদি আরব ও কাতারের অভিবাসন ব্যয় আকাশচুম্বী বেড়ে গিয়েছিল। তখন ১০ থেকে ১৬ লাখ টাকায় বিক্রি হতো সৌদির ভিসা। অন্যান্য ভিসা ট্রেডিংও বেড়েছিল অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু জিটুজি প্লাস চালুর পর সৌদি ও কাতারের অভিবাসন ব্যয় আড়াই লাখ টাকায় নেমে আসে। আর সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া যাওয়ায় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার যে দুর্নামে পড়েছিল তা থেকে মুক্ত হয়েছে দুই দেশ। এক অর্থে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল।

সর্বশেষ খবর