রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষার অধিকার হারালে বৈষম্যের জায়গাটি পাকাপোক্ত হতো

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ভাষার অধিকার হারালে বৈষম্যের জায়গাটি পাকাপোক্ত হতো

ভাষা আন্দোলন একমাত্রিক শুধু ভাষার লড়াই ছিল না; আন্দোলনটি ছিল বহুমাত্রিক।

যারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সামনে বড় প্রশ্নটি ছিল মাতৃভাষা বাংলা। প্রাথমিকভাবে ভাষা আন্দোলনটি ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে অনেক মাত্রা। প্রথমত, ভাষা শুধু মানুষের ভাব বিনিময়ের মাধ্যম নয়; ভাষার মাধ্যমে সংস্কৃতিরও প্রসার হয়। সংস্কৃতির বাহন হলো ভাষা। আমরা যদি বাংলা ভাষার অধিকারটি হারাতাম, তাহলে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা স্তব্ধ হয়ে যেত। একেবারে থেমে যেত তা নয়, তবে মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে যে স্ফুরণটি থাকে, সেই স্ফুরণটি থাকত না। কাজেই বাঙালি সংস্কৃতির জন্য একটা অশনিসংকেত ছিল পাকিস্তানি সিদ্ধান্ত। রাজনীতির কথা যদি বলি, বলা হয় বাঙালির ভাষাভিত্তিক রাজনীতির কারণেই এই বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ হয়; এটা যেমন সত্য, একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদও ভাষা আন্দোলনের মতো বহুমাত্রিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নির্মাণের পেছনে ছিল ভূগোল। তা না হলে আমরা ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে কেন স্লোগান দেব ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’? আবার বাঙালির বীরত্বের ইতিহাসও আছে, যখন স্লোগান দিয়েছি, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। ছিল নৃতাত্ত্বিক বিষয়ও। তাই তো স্লোগান দিয়েছি ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি, বাঙালি’। অর্থাৎ, বাঙালির ঐতিহ্যকে আমরা সামনে এনেছি, ভূগোলকে সামনে এনেছি, নৃতাত্ত্বিক বন্ধনকে সামনে এনেছি। এগুলোর সঙ্গে ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি এবং রাজনীতি- সব মিলে আমাদের এই জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল। কাজেই জাতীয়তাবাদ ভাষা আন্দোলনের মতোই বহুমাত্রিক।

ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অর্থনীতিরও। যদি বাংলা ভাষার অধিকার আমরা হারাতাম, তাহলে আমাদের আর্থিক জীবনও আড়ষ্ট হয়ে পড়ত। বাঙালিকে উর্দু শিখে চাকরির সন্ধান করতে হতো। এক্ষেত্রে অগ্রসর পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে আমরা হেরে যেতাম। এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যতদিন ছিলাম, ততদিন বাঙালিরা বৈষম্যের শিকার হয়েছি। এই ক্ষেত্রে বৈষম্যের জায়গাটি বেশ পাকাপোক্ত হয়ে যেত। মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশ ভারতে ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষা চালু করার পরে হিন্দু সম্প্রদায় সোৎসাহে ভাষা শিখল, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরি-বাকরিতে অনেকটা এগিয়ে গেল। মুসলমানরা মনের দুঃখে ইংরেজিও শিখল না, বা ইংরেজি শেখার জন্য তাদের অবস্থান অনুকূলও ছিল না। সব মিলিয়ে দেখা গেল, উনিশ শতকের শেষে হিন্দুরা অনেক অগ্রসর, মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়। হিন্দু-মুসলমানের এই দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা হিন্দু বা মুসলমান নেতারা কেউ করেননি। বরং উভয় নেতারা ধর্মের জিগির তুলে ভারত উপমহাদেশে বিভাজনকে অনিবার্য করে তুলেছিল। একই অবস্থা হতো যদি আমরা বাংলার অধিকারটি হারাতাম। আমি বিমুগ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ইঞ্জিনিয়ারস ইনস্টিটিউশনে এবং ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমিতে বক্তৃতার সময় এই ভাষা আন্দোলনের বহুমাতৃকতা সম্পর্কে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর মধ্যে যথার্থ ইতিহাস চেতনা ছিল বলেই তিনি এই বহুমাতৃকতার দিক নির্দেশনা দিতে পেরেছিলেন জাতির সামনে। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান বিশ্বস্বীকৃত। তার প্রমাণ হচ্ছে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো আমাদের অমর একুশকে সারা বিশ্বের একুশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এতে দুটো কাজ হয়েছে। প্রথমত, বাঙালির এই আত্মত্যাগকে বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিল; দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর তাবৎ ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতিকেও স্বীকৃতি দিল। ইউনেস্কোর হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার ৯০০টি ভাষা আছে। এই ভাষাভিত্তিক সব সংস্কৃতিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কাজেই আমাদের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও ছিল। এটাও একটা মাত্রা। সামগ্রীকভাবে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাঙালি জাতি যথেষ্ট গর্বিত। কিন্তু, এই গর্ব আমরা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। আমরা অতি উৎসাহের ফলে ইংরেজিকে তাড়িয়েছি, আবার ইংরেজিকে ব্যবসায়িকভাবে পণ্য হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছি। ফলটা হচ্ছে, আমরা কেউ সঠিকভাবে ইংরেজিও জানি না, বাংলাও জানি না। বাংলাকে বলি ফেব্রুয়ারি মাসের দুখিনী বর্ণমালা। কিন্তু, এই দুখিনী বর্ণমালাকে সুখী করবার চেষ্টা কি করেছি কখনো? বাংলা ভাষার চর্চা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে বা পত্র-পত্রিকায় যেভাবে হচ্ছে, তাতে যথেষ্ট লজ্জার ব্যাপার রয়ে গেছে। আমরা বাংলা উচ্চারণও ঠিকভাবে করতে পারি না, লেখা তো দূরের কথা। আবার ইংরেজি যারা দু-চার পাতা শিখেছি, তারাও সঠিকভাবে ইংরেজি বলতে, পড়তে, লিখতে পারি না। সবচেয়ে কষ্ট লাগে যে, ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মূল গ্রন্থটি ছিল বাংলায়। বইটার যে ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে, তার প্রতিটি পাতায় ভুল। ফলে বিদেশিদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভুল বার্তা যাচ্ছে। সুতরাং, আমাকে বাংলা শিখতে হবে সঠিকভাবে, ইংরেজিকেও সমাদর করতে হবে, কারণ ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা মাধ্যম। লেখক : ইতিহাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বিইউপি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

সর্বশেষ খবর