সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ফাস্টফুড ভাষা

শামীম আজাদ

ফাস্টফুড ভাষা

সংযোগের সুযোগ নিতে বা সদ্ব্যবহার করতে আমরা যাহা পাই তাহাই কাজে লাগিয়ে এগোতে চাই। ভাষার বেলায় হাতের কাছে পাওয়া পরিশ্রমবিহীন সব পণ্যই খরিদ করার চেষ্টা করি। তারপর তার সফল ব্যবহারের কাজে লেগে যাই। তা নিজ ভাষার চালিকা শক্তি বৃদ্ধির কাজে লাগে বলেই লাগাই। সেখানে গতিই মুখ্য- স্থিতি নয়। সেখানে শূন্যস্থানের অবকাশ নেই। চিন্তারও।

এক একটি গতি বৃদ্ধিকারক শব্দ তখন আমার ভাষার ফুসফুসের জন্য তাজা অক্সিজেন। সেটা দূষিত হলেও। কারণ আমার যে শ্বাস নিতে হবে! হবে না? অক্সিজেনের সঙ্গে তুলনাটা আমার বেশ পছন্দ হলো। আমরা বলি অক্সিজেন বন্ধ হলে দমবন্ধ হয়। আসলে অক্সিজেন নেওয়ার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে দমবন্ধ হয়ে যায়। ভাষার প্রশ্নে এ ব্যাপারটা আমরা খুব টের পাই নতুন কোনো স্থানে গিয়ে ভাষা না বুঝলে, কথা না বলতে পারলে। আর কথাতো শুধু কথা নয়। তার সঙ্গে তার বহিঃপ্রকাশ, সংস্কৃতি, সংরাগ সবই আছে। নতুন জগতের, মহা সম্ভাবনার দুনিয়ার চাবি বা বাজি হলো নতুন শব্দোচ্চারণ। চাবি ঘোরালেই তা খুলে যাবে আর তাতেই হবে বাজিমাত। তাই আমরা প্রাণপণ করে সে ভাষা শিখি। নতুন কোনো গ্রাম হলে সে গ্রামের। মহল্লার হলে মহল্লার, দেশের হলে সে দেশের। প্রথমে দুই-একটি নতুন শব্দ যখন বলি, যেন ডিনামাইট ফেটে যায়। সত্যি ভাষানালি খুলে যায়। তখন তা আরও আহরণ করতে উৎসাহ জাগে। কারণ নতুন জানা শব্দের আয় কাজে লাগতে শুরু করে। তখন যতটা পারা যায় বা পাওয়া যায় ততটা নিয়েই সুগৃহিণীর মতো তা ব্যয় করে টিকে থাকতে হয়। নতুন ভাষা জামার পকেটে পুরানো কোনো পাথর ভরি না- যাতে তা হালকা লাগে। অর্থাৎ তখন সীমিত আয়ে অধিক ব্যয়ের নানান কৌশল করতে শুরু করে দিই। কিন্তু মোক্ষ হয়ে ওঠে যা পরীক্ষিত, সংযোগ সফল, প্রাকৃত, নিশ্চিত এবং সুগম্য। আর আমরা তা থেকে ভাষার সূচক নির্ধারণ করি। লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা যে দেশে যা সেখানে ভাষা সমভাষীদের মধ্যে হাঁটে একভাবে, সংকর প্রবাহে হাঁটে শ্লথভাবে এবং জনে জনে তা বিবিধও হয়ে যায়। তার মধ্যেও দুই ভাগ, পোশাকি ও ঘরোয়া ভাষা। ওহ, ঘরেরও  থাকে আবার আরেক ভাষা। নিজস্ব ভাষা আছে প্রেমিক-প্রেমিকার, স্বামী-স্ত্রীর, বাৎসল্যের। আছে দলের, গোষ্ঠীর, শ্রমজীবীর, বুদ্ধিজীবীর। এসব তুলাদন্ডেও এক করা যায় না। আবার যায়ও। শব্দমালার অবয়ব বা ধ্বনি দেখেশুনে তা করা যায়। তবে মানুষ নিজ স্বাভাবিকতায়ই এর প্রাকৃত ধারা রাখে। সেটা তার এক অনায়াস ভ্রমণ। আর তাই হয়ে ওঠে জনগণের ভাষা প্রান্তজনের সখা। এখন এই সখা বা সাথীকে সবার পছন্দ কিনা তার একটা প্রশ্ন থেকে যায়। প্রশ্ন তাদের কাছ থেকেই আসে যারা ভাষার কারবারি। তারা ভাবেন ভোক্তারা যেদিকে প্রবাহিত হয়েছে তিনি বা তারা সেদিকে যাবেন কি যাবেন না। সহজ পদ্ধতিতে রান্না করে দ্রুত উদরসেবা চলতে পারে।  এমন কিছুই সবাই পছন্দ করেন। সুপার মার্কেটের র‌্যাক সেরকম খাবারে ভরে যায়। পাশে পড়ে থাকে অপেক্ষাকৃত দামি অরগ্যানিক ফুড। ফাস্টফুডের ড্রাইভ থ্রোতে জ্যাম হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। হার্ব খেত বা  জৈবিক সারের ক্ষেত্রটার রক্ষণাবেক্ষণও হয় না। আমাদের রেডিও, টিভি, ফেসবুক লাইভ, জুম, অনলাইন পোর্টাল, ইউ টিউবে প্রধানত যা উচ্চারিত হচ্ছে তাকে কিছুতেই মান ভাষা বলা যায় না। বর্তমান সময়ের তরুণ তরুণীরা ওই ফাস্টফুডেই বেজায় আসক্ত। যাহা টেবিলে আসিতেছে তাহাই তাদের খাদ্য হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এসব সংস্থা বা সংগঠনের ভাষা বদলে দিচ্ছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষাও। কিন্তু ফলন বাড়ছে অবিরাম। অধিক ফলনই সূচক হয়ে যাচ্ছে। ভাষার অজুহাতে যা চলছে তাকে কোনো মতেই মানের স্থানে বসানো যায় না। এই যে একুশে বইমেলা, তাতে প্রতিদিন শত শত গ্রন্থের প্রকাশ ঘটছে। কিন্তু হাতে নিয়ে দেখুন কটি মানসম্মত। বানান, ছাপা, ভাষা, বাঁধাই, কাগজ, বিপণন সব নিয়ে প্রশ্নই থেকে যায়। সে গ্রন্থগুলোকে বাংলা ভাষার ‘গ্রন্থ’ বলে টিভি আলোচনা,পত্রপত্রিকার আলোচনায় আনাও উচিত নয়। আমি ভাষার কারবারি। আমাদের বাংলাদেশের ভাষার একটা মান আছে। হ্যাঁ ওই মান ভাষার কথাই বলছি। তবে এটাও স্বাভাবিক যে দেহে পচন ধরলে আবার মানুষ ফিরে যায় অর্গানিক খাবারে। তখন দেখা যায় সে বাগানের চাহিদা কমতে কমতে তা ক্ষীণ ও খর্ব হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ মান ভাষার কাছে ফিরবেই। এ আমার বিশ্বাস। লেখক : কবি ও কলামিস্ট, লন্ডন

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর