বুধবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

দেশের মানুষ ভালো থাকলেই আঘাত আসার আশঙ্কা থাকে : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের যখন একটু ভালো সময় আসে, মানুষ একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, জীবনমান একটু উন্নত হয় তখনই কিন্তু একটা আঘাত আসার আশঙ্কা থাকে। সে কারণেই সবাইকে একটু সতর্ক থাকা দরকার। গতকাল সকালে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই, ২০২০-জুন, ২০২৫) দলিলের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে জাতির পিতা যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন, দেশটা উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে সে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবং তার সুফলও মানুষ পেতে শুরু করেছে, মানুষ একটু খুশি এবং স্বস্তিতে ঠিক সেই সময়ে কিন্তু ১৫ আগস্টের ঘটনাটা ঘটল।’ তিনি বলেন, ‘একটা বিষয় আমি সব সময় স্মরণ করাতে চাই যখন বাংলাদেশে একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, জিনিসপত্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে, ব্যাপকভাবে ফসল উৎপাদনের প্রস্তুতি এবং সেটা হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা গেছে, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ সব চালু- সব দিক থেকে মানুষ যেন একটা স্বস্তিতে ফিরে এসেছে তখন শুধু জাতির পিতাকে হত্যা নয়, আমি আমার পরিবারের সবাইকে হারালাম।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় সবার সহযোগিতায় তাঁর সরকারের করোনা মোকাবিলার সাফল্য তুলে ধরে বলেন, ‘ভৌগোলিক দিক থেকে ছোট হলেও জনসংখ্যার দিক থেকে বড় এই দেশে আমরা করোনা মোকাবিলা করে একে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলায় আমরা যেমন নির্দেশনা দিয়েছি, প্রণোদনা দিয়েছি তেমনি ভ্যাকসিন প্রদানও শুরু করেছি যা বিশে^র অনেক উন্নত দেশও এখনো আনতে পারেনি।’ তিনি ভ্যাকসিন নিয়ে বিশে^র বিভিন্ন দেশের গবেষণা চলার সময়ই এটি চালু হলে বাংলাদেশ যেন আগে পেতে পারে সে জন্য আগাম অর্থ দিয়ে বুকিং করে রেখেছিলেন বলেও উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা এ সময় দেশবাসীর প্রতি পুনরায় কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করে বলেন, ‘তারা ভোট দিয়েছিলেন বলেই আমরা ক্ষমতায় আসতে পেরেছি এবং তাদের সেবা করার সুযোগটা পেয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারা বিশে^র অর্থনীতি আজ স্থবির। অনেক উন্নত দেশ না পারলেও বাংলাদেশ আজ ভ্যাকসিন দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পেরেছে। তিনি ’৭৫-পরবর্তী স্বৈরশাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এ দেশে গণতন্ত্র কখনো অব্যাহতভাবে চলেনি। জাতির পিতাকে হত্যার পর একের পর এক মার্শাল ল এবং সামরিক শাসকরা দেশ চালিয়েছে। হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতিই দেশে চলেছে। এর সঙ্গে অগ্নিসস্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সবই আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে এবং এসব মোকাবিলা করেও আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। করেনাভাইরাস মোকাবিলায়ও আমরা সাফল্য অর্জন করেছি এবং করে যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ যথেষ্ট সচেতন বলে এ করোনাভাইরাসের প্রভাব আর খুব বেশি আমাদের দেশে থাকবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা আগেই আমরা অনুমোদন দিয়েছিলাম। আর আজকে আমরা মোড়ক উন্মোচন করলাম। এর বাস্তবায়নও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।’ তিনি বলেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তিনি ভাষার মাসে সব ভাষাশহীদকে স্মরণ করে বলেন, ‘দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করাতে বছরের প্রতিটি দিনই কিছু না কিছু স্মৃতি আমাদের রয়ে গেছে। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাক, সুস্থ থাক এবং স্বাধীনতার চেতনায় বাংলাদেশ গড়ে উঠুক এটাই আমাদের একমাত্র কামনা।’

চার লেনের সিলেট মহাসড়কে দিতে হবে টোল : ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হওয়ার পর তা ব্যবহারে টোল দিতে হবে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গতকাল একনেকে ‘সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পটি অনুমোদনের পর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। অন্যগুলোর তুলনায় এ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। একনেক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সভায় ঢাকা-সিলেট চার লেন প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এ সড়ক নির্মাণ শেষ হলে টোল আদায় করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বিনা পয়সায় সেবা পাওয়ার দিন শেষ। আমরা সেবা পেতে চাই কিন্তু পয়সা দিতে রাজি না। এটা আমাদের কালচার। এ কালচার থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। দেশের সব বড় বড় সড়কে টোল আদায়ের ব্যবস্থা করতেও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ওই অর্থ একটা ইয়ার মার্ক অ্যাকাউন্ট করে জমা রাখতে হবে। যেন ওই সড়কগুলো মেরামত করতে হলে ওই অ্যাকাউন্টের অর্থ দিয়ে করা যায়।

ব্যয় বাড়ার ব্যাখ্যা : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের লক্ষ্যে এডিবির অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ৯০ লাখ টাকা, বাকি ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকার অর্থায়ন করবে এডিবি। দেশে এর আগের বিভিন্ন মহাসড়ক চার লেনে করতে যে ব্যয় হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হতে যাচ্ছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে।

 প্রায় ২১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়ক চার লেনের করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ৮০ কোটি টাকার বেশি। যেখানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছিল ২১ কোটি টাকা। ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর মহাসড়কে এ ব্যয় ছিল ২১ কোটি টাকা। হাটিকুমরুল থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণে ছিল ৫৫ কোটি টাকা।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে ব্যয় বাড়ার কারণ দেখিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যা ব্যয় হওয়ার তাই হবে। কস্ট কমপ্রোমাইজ করে কোয়ালিটি কমপ্রোমাইজ করা যাবে না। তিনি বলেন, ‘এটা একটা হিউজ প্রজেক্ট। এ প্রকল্পে ৫ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আছে। এ কস্টও তো আমাকে ধরতে হবে। এ ছাড়া দুই পাশে সার্ভিস লেন রয়েছে।’ তিনি বলেন, এ মহাসড়কে যাত্রী ও গাড়িচালকদের নানা সুবিধাও নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই যে সড়কে যাওয়ার পথে যেন বিশ্রামের জায়গা থাকে, কফি খাওয়ার জায়গা থাকে। একটু বসে হালকা হওয়ার জায়গা থাকে। একটা সুন্দর ওয়াশরুম যেন থাকে। নারীদের চেঞ্জিং রুম ও বসার জায়গা যেন থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ অন্যান্য মহাসড়কেও এসব ব্যবস্থা রাখতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

হালদা নদীর তীর ভাঙন রোধে নেওয়া প্রকল্প প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, হালদা নদীতে উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে সেখানকার মাছের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এ জন্য মৎস্যবিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে কাজ করতে বলেছেন। মন্ত্রী বলেন, ‘নদী ড্রেজিংয়ের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হলো কোনো কাজ শুরু করে তা ফেলে রাখা চলবে না। যে নদীতে ড্রেজিং শুরু হবে তা যতক্ষণ শেষ না হবে চালিয়ে যেতে হবে। কাজ শুরু করলে তা ফেলে না রেখে শেষ করতে হবে।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু করে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ভারত, চীন, মিয়ানমার, ভুটান, নেপালসহ ছয় দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য এ টেকসই সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে বলে সরকার জানিয়েছে। মন্ত্রী মান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অতীতে আমরা পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এখন সময় এসেছে পুব দিকে তাকানোর।’

নয় প্রকল্পের অনুমোদন : জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১৯ হাজার ৮৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নয়টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর