শিরোনাম
শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় দরকার

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় দরকার

অসম্ভব উন্নত একটি ভাষা ‘বাংলা’। ভাষা আন্দোলনটা ছিল বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বর্তমানে চলছে ভাষাটিকে সর্বস্তরে প্রচলন করার প্রেক্ষিত। প্রায় ৩৮ কোটি মানুষ সারা পৃথিবীতে বাংলায় কথা বলে। আমরা চাই এই বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসেবে জাতিসংঘেও প্রতিষ্ঠা করতে। আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষা পেয়েছি। এখন ভাষাটির বিস্তার, রক্ষা এবং সেই ভাষার শিল্প-সাহিত্যকে ত্বরান্বিত করা, উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়া আমাদের মূল কাজ। ভাষা ব্যবহার নিয়ে বর্তমানে আমাদের একটা সংকট আছে। বাংলা একাডেমি এজন্য কাজ করছে। তবে এখন একটি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় হলে বাংলা ভাষা নিয়ে নিত্য দিনের ছোট ছোট সংকটগুলো কেটে যাবে। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা ও জানার কাজটি করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। এটি বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষাকে যুক্ত করে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকে দৃঢ় করবে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে সূচনা হয়েছিল বাংলা একাডেমির। বাংলাদেশ হওয়ার পর বাংলা ভাষার লিখিত ও কথ্যরূপ এই বঙ্গে এসে একটু বদলে গেছে। কারণ ভাষা সব সময় চলমান। ভাষা তার নিজস্ব জল-হাওয়া নিয়ে একটি রূপের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পূর্ব বাংলার লোকজন যেভাবে বাংলা বলেন, পশ্চিম বাংলার লোকজন সেভাবে বলেন না। আঞ্চলিক ভাষার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। তবে বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের এ অঞ্চলে যে কাজ হচ্ছে, আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে প্রমিত ভাষার ক্ষুদ্র দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে একটি নতুন বাংলা ভাষার রূপ এখানে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রকৃত রূপ নিয়ে সার্বিকভাবে কিছু করতে আরেকটু সময় লাগবে। কাজ হচ্ছে। যেমন বাংলা একাডেমি অভিধান বের করে। আঞ্চলিক ভাষার অভিধানও আছে। বাংলা একাডেমি এই প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ করেছে। বিবর্তনমূলক অভিধানও করেছে। বাংলা একাডেমি নিত্য এই কাজ করছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন আমাদের একটি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করাতে যা যা করণীয় করবে। বাংলা ভাষার বিভিন্ন রূপান্তর, অন্য ভাষায় বাংলা ভাষার সাহিত্যকে রূপান্তর করা, শিল্পের অংশগুলোকে রূপান্তর করা এবং সেটাকে সারা পৃথিবীতে বিস্তার ঘটানো এখন আমাদের দায়িত্ব। সর্বস্তরে বাংলা প্রবর্তন করা কোনো বিপত্তির বিষয় নয়। এত দিন পর্যন্ত আমাদের আদালতগুলোতে ইংরেজিতে রায় দেওয়া হতো। অথচ সর্ববৃহৎ একটি রায় (পিলখানা হত্যাকান্ড) বাংলায় হয়েছে। এখন আমরা খুঁটিয়ে দেখছি বাংলায় অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কী কী অসুবিধা হচ্ছে। ভাষার জন্য পূর্বে রচিত ইতিহাসগুলো খন্ডিত ইতিহাস। এখন সার্বিকভাবে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার কাজ চলছে। এ বছর একুশে গ্রন্থমেলাতেই বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা ভাষার ওপরে, ভাষা আন্দোলনের ওপরে, বাংলা ভাষার কর্মের ওপরে বই প্রকাশ করা হচ্ছে। আমরা চাই সার্বিকভাবে সবার সহযোগিতায় ভাষা আন্দোলনের রূপটি সুস্পষ্টভাবে বলতে যাতে তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত না হয়, আর এই ভাষাকে আমরা আগামী দিনে কীভাবে নিয়ে যাব সেই রূপরেখাটিও তৈরি করতে চাই। এখন শিক্ষা আর ভাষা শিক্ষা- দুইটা ব্যাপার হয়ে গেছে। ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তরুণরা অগ্রসর, কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তারা বাংলাকে মেনে নিতে চায় না। এজন্য তরুণদের চেয়ে বেশি দায়ী অভিভাবকরা। তারা সন্তানদের বোঝান যে, বাংলায় শিখলে আন্তর্জাতিকভাবে চলাচল করতে অসুবিধা হবে। এটা ভ্রান্ত ধারণা। ভাষা হিসেবে অন্য ভাষা শিখুক কিন্তু মাতৃভাষা হিসেবে শিক্ষার অংশটুকু তারা বাংলা ভাষাকে নিয়ে যাপন করুক- এটাই হওয়া উচিত। মূলত, ভাষার বিস্তার ও চর্চার সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক অনেক। এক সময় সরকারি চাকরির চেয়ে করপোরেট চাকরির প্রতি তরুণরা বেশি আগ্রহ বোধ করত। এ কারণে তারা বাণিজ্যিক শিক্ষায় আগ্রহী হতো। বাণিজ্যিক শিক্ষায় আগ্রহী হওয়ায় ভাষা নিয়ে তাদের চিন্তা কম ছিল। অতিসম্প্রতি তরুণরা সিভিল সার্ভিসের দিকে আগ্রহী হয়ে পড়েছে। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে যেতে চায়। কারণ তারা দেখছে এখানে সম্মান, আর্থিক নিরাপত্তা সবই বেশি। কিন্তু ভাষা শিক্ষার মূল ব্যাপারটি আমাদের সঙ্গে থাকতেই হবে। শুধু তরুণদের আগ্রহই নয়, পাঠ্যক্রম এভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পরবর্তী প্রজন্ম নিজ মাতৃভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে এবং তা দিয়েই তারা নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে আমি বিশ্বাস করি, আগামী ৫০ বছরে আমাদের তরুণরা শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে এই বাংলা ভাষা নিয়ে, বাংলায় চিন্তা নিয়ে, বাংলার রূপ নিয়েই তারা রাজত্ব করবে। সেই দিন আসছে। লেখক : বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। অনুলেখক : শামীম আহমেদ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর