শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাউস উপকমিটি আওয়ামী লীগে

শতকের ঘর ছুঁয়েছে অনেক উপকমিটি । কোনো কোনো কমিটি নিয়ে চলছে লুকোচুরি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাউস উপকমিটি আওয়ামী লীগে

আওয়ামী লীগের বিভাগীয় উপকমিটিগুলো আবারও ঢাউস আকৃতিরই হচ্ছে। ৩৫ সদস্যের মধ্যে কমিটি করার মৌখিক নির্দেশনা থাকলেও শতকের ঘর ছুঁয়েছে অনেক উপকমিটি। আবার কোনো কোনো কমিটি নিয়ে চলছে লুকোচুরি। সংখ্যা কত তা জানানো হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যে উপকমিটির সদস্য, সেই কমিটিতে আছেন উপজেলা পর্যায়ের নেতাও। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও সদস্য, তাদের চার-পাঁচ কমিটির পরের কমিটির সবচেয়ে নিচের স্তরের নেতাও একই ক্যাটাগরির সদস্য। আবার জীবনে কখনো জয় বাংলা বলেননি, এমনকি শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচক পেশাজীবীরাও ঠাঁই পেয়েছেন আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে। এখানেই শেষ নয়, জাতীয় পার্টির এমপির ব্যক্তিগত সহকারীও এখন আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্য। মানা হয়নি ‘এক নেতার এক পদ’ নীতিও। জেলা-উপজেলা বা সহযোগী সংগঠনের পদে আছেন এমন নেতাদেরও সদস্য করা হয়েছে উপকমিটিতে। উপকমিটির মান নিয়ে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হতে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এদিকে কমিটির আকার বড় হওয়ায় আবার ‘সাহেদ’দের মতো সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটার শঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করছেন অনেকে।

দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বলছেন, দল ও সহযোগী সংগঠনের বঞ্চিত নেতাদের জায়গা দিতেই কমিটির আকার কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। এবার বিতর্কিত ও ‘অনুপ্রবেশকারী’ ঠেকাতে অনেক বেশি সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল। সূত্র জানায়, ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের পর ৬৬ জনকে সহ-সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, যার অধিকাংশই ছিলেন সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতা ও দেশব্যাপী পরিচিত মুখ। ২০১৩ সালে শেষের দিকে দশম জাতীয় সংসদ সামনে রেখে সাবেক ছাত্রনেতাদের দলীয় কার্যালয়মুখী এবং সক্রিয় করতে কয়েক শ নেতাকে সহ-সম্পাদক পদের চিঠি দেওয়া হয়। সে সময় সহ-সম্পাদক পদের নাম ভাঙিয়ে অপকর্মের সঙ্গে অনেকেই জড়িয়ে পড়েন। কোনো যাচাই-বাছাই না করে ঢালাওভাবে সহ-সম্পাদক করায় অনেক সুযোগসন্ধানী ও দুষ্কৃতকারী দলে ঢুকে পড়েন। এর ফলে অপকর্মকারীরা আরও সুযোগ নিতে থাকেন। এ নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে সমালোচনা ওঠে। সে সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডি কার্যালয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘যার গায়ে ধাক্কা লাগে সে-ই সহ-সম্পাদক।’

এসব বিষয় উপলব্ধি করে আওয়ামী লীগের বিগত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সহ-সম্পাদক পদ বাদ দেওয়া হয়। তবে উপকমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এতে যারা থাকবেন, তাদের মধ্যে চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিব ছাড়া প্রত্যেকে কমিটির সদস্য হবেন। তবে কত                সদস্যের কমিটি হবে তা নির্দিষ্ট করে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে বলা হয়নি। এরই মধ্যে গত বছর আওয়ামী লীগের এক উপকমিটির সদস্য ‘প্রতারক’ সাহেদকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে যায় দলটি। পরবর্তী সময়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে সম্পাদকমন্ডলীর এক সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপকমিটির সদস্য ৩৫ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। অন্য কোনো সংগঠনের পদে আছেন এমন কাউকে উপকমিটিতে না রাখার পরামর্শও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ১৭ সম্পাদকদীয় পদের ঘোষিত প্রায় ১৩টি কমিটিতে দেখা গেছে, অধিকাংশেই দলের সাধারণ সম্পাদকের মৌখিক নির্দেশনা মানা হয়নি। যে যার মতো করে কমিটি গঠন করেছেন। সর্বশেষ বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটি অনুমোদন করা  হয়েছে। কমিটি কত সদস্যের তা বলা হয়নি। প্রায় ৬০ জনের একটি খসড়া নামের তালিকা গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন উপকমিটির সদস্যসচিব ড. সেলিম মাহমুদ। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কত সদস্য ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। অনেক সময় পরিবর্তন হতে পারে, আবার নতুন সংযুক্তি আসতে পারে। সে কারণে পুরো কমিটি ফেসবুকে দেওয়া হয়নি। যারা কমিটিতে আছেন, তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে।’ তথ্য ও গবেষণা উপকমিটিতে যারা পদ পেয়েছেন তাদের অনেকেই বলছেন, কমিটির আকার ৮০-৯০ জনের হতে পারে।

ইতিমধ্যে ৩৫ সদস্যের প্রচার ও প্রকাশনা, ৪০ সদস্যের শিক্ষা ও মানবসম্পদ, ৪৫ সদস্যের সংস্কৃতিবিষয়ক, ৪২ সদস্যের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা, ৫০ সদস্যের মহিলাবিষয়ক, ৫৫ সদস্যের কৃষি ও সমবায়, ৫৫ সদস্যের অর্থ ও পরিকল্পনা, ৬০ সদস্যের শিল্প ও বাণিজ্য, ৭২ সদস্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক, ১০০ সদস্যের বন ও পরিবেশবিষয়ক উপকমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত কমিটিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট সংখ্যায় কমিটি রাখা হয়নি। যে যার মতো করেই কমিটি করেছেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগে ইচ্ছামতো কমিটি করার সুযোগ আছে? প্রয়োজন থাকলে সেটা দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে করা যেতে পারে। উপকমিটি নিয়ে কোথাও কোনো বাড়াবাড়ি হয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’

আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলেয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কমিটির সংখ্যা কত ঠিক এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। আগামীকাল (আজ) কাগজ দেখে বলব। কমিটি গঠনে আমাদের তিনটা মানদন্ড ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। এক. দলীয় এমপি, দুই. বিশেষজ্ঞ, তিন. সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবনেতা। যাদের প্রয়োজন মনে করা হয়েছে তাদের রাখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু আমার কমিটিই বড় নয়, আরও অনেকেই এমন বড় কমিটি করছেন। আমি পথ দেখিয়েছি মাত্র। সেই পথেই অন্যরা হাঁটছেন।’

আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কত সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দেশের বাইরে আছি। কত সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছে সঠিক বলতে পারছি না। দেশে ফিরে বলব।’

আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ৩৫ সদস্যের উপকমিটি গঠন করেছি।’ জানা গেছে, উপকমিটিতে সাবেক ছাত্রনেতা ও দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছেন দলীয় সংসদ সদস্য, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও। তবে এক ব্যক্তিকে একাধিক কমিটিতে রাখা যাবে না এমন নির্দেশনা মানা হয়নি অনেক ক্ষেত্রেই। আগে সহযোগী সংগঠনের আরও দুটি পদে আছেন এমন কাউকে কাউকেও উপকমিটিতে রাখা হয়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দল বা সহযোগী সংগঠনের পদে আছেন এমন নেতাদেরও জায়গা দেওয়া হয়েছে উপকমিটিতে।

সর্বশেষ খবর