রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

উচ্চ আদালতে বাড়ছে বাংলার ব্যবহার

আরাফাত মুন্না

গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চের কার্যতালিকার এক নম্বরে ছিল মেরাজ শেখ বনাম রাষ্ট্র শিরোনামে থাকা একটি মামলা। ধর্ষণ সংক্রান্ত এ মামলায় আদালতের তলবে হাজির হয়েছিলেন নয় চিকিৎসক ও তিন পুলিশ কর্মকর্তা। সেদিন বাংলা ভাষায় নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন আইনজীবীরা।

আগের দিন বুধবার গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা পুঁতে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা মামলার রায় বাংলায় দেয় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ।

শুধু এ মামলা নয়। কয়েক বছর ধরে বাংলায় শুনানি গ্রহণের পাশাপাশি রায় ও আদেশও মাতৃভাষায় দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে হাই কোর্টের বিচারপতিদের মধ্যে। সম্প্রতি আপিল বিভাগ থেকেও রায় এসেছে বাংলা ভাষায়। সুপ্রিম কোর্টের অনেক আইনজীবী এখন নিয়মিতই বাংলায় শুনানি করছেন। এ ছাড়া আদালতে বাংলাভাষার প্রয়োগকে আরও সহজ করতে আইন কমিশনের উদ্যোগে ১০ হাজারেরও বেশি বাংলা পরিভাষা নিয়ে মুদ্রিত হয়েছে ‘আইন-শব্দকোষ’। অন্যদিকে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের ইংরেজিতে দেওয়া রায় ও আদেশ বাংলায় অনুবাদ করতে ‘আমার ভাষা’ নামে একটি সফটওয়্যারও তৈরি করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করেন। সব মিলিয়ে উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার বাড়ছে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, অনেক অপেক্ষার পর বিচারপতিরা বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটা ভালো দিক। বাংলায় রায় ও আদেশের বিষয়ে নতুন প্রজন্মের আইনজীবীদের বেশি ভূমিকা রাখতে হবে বলেও মনে করেন আইনজ্ঞরা।

জানা গেছে, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে বর্তমানে ১৩ জন কম-বেশি বাংলায় রায় ও আদেশ দেন। এর মধ্যে হাই কোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন নিয়মিত রায় ও আদেশ বাংলায় লিখে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন। এরপরই আছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। তিনি ২ হাজারেরও বেশি রায় ও আদেশ দিয়েছেন বাংলা ভাষায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আরও কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় রায় ও আদেশ দিয়ে আলোচনায় আছেন। তারা হলেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী এবং হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম, বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান, বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান, বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন।

উল্লেখ্য, সব ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। সংবিধানেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। তবে আজও উচ্চ আদালতে পূর্ণাঙ্গভাবে এ বিধান কার্যকর হয়নি। আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে নয় বছর আগে আইন কমিশন থেকেও সরকারকে সুপারিশ করা হয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ’৯০-এর দশকে উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়। প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি এম আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলায় কয়েকটি আদেশ ও রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আইন সাময়িকীর (ঢাকা ল রিপোর্টস ৫০ ও ৫১ ডিএলআর) তথ্যানুসারে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। একই সময়ে বিচারপতি হামিদুল হক অন্য একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায়ও বাংলায় রায় দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সাবেক বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বাংলায় বেশ কয়েকটি রায় দিয়েছেন।

উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাভাবিক রীতিতে উচ্চ আদালতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে এখন অনেক বিচারপতি বাংলায় রায় দিচ্ছেন, এটা ভালো দিক। তিনি বলেন, আপিল ও হাই কোর্ট বিভাগে আইনজীবীরা বাংলায় যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন। বিচারপতিরা বাংলায় জবাব দিয়ে থাকেন। উচ্চ আদালতের কার্যক্রমে বাংলাভাষার প্রচলন আরও বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।

জানতে চাইলে হিউম্যানরাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, বিচারপতিরা এখন বাংলায় রায় লিখছেন, এটা খুবই ভালো দিক। অনেক আইনজীবীও এখন বাংলায় শুনানি করেন। তবে এখনো পুরোপুরি বাংলায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। অনেক আইন ও রেফারেন্স ইংরেজিতে। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে পুরোপুরি বাংলার প্রচলন করতে হলে নতুন প্রজন্মের আইনজীবীদের বেশি ভূমিকা রাখতে হবে।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ২০৯০ জনকে চিঠি : উচ্চ আদালতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কার্যকরে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, আইনমন্ত্রী এবং উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালতের বিচারকসহ ২ হাজার ৯০ জনকে চিঠি ও মেইল পাঠিয়েছে বেসরকারি সংগঠন হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুর রহমানের পাঠানো এ চিঠিতে আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সংবিধান ও আইনি যুক্তিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলা ভাষায় রায় পাওয়া নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। এটিই চিঠিতে সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে ধরে উচ্চ আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা কার্যকরে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর