সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মহামারীর মতো বাড়ছে আত্মহত্যা

সব বয়সী মানুষের মধ্যে বেড়েছে প্রবণতা, বিষণ্নতা, নানামুখী বৈষম্য ও প্রতারণা অন্যতম কারণ

সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

করোনা মহামারীতে হঠাৎ করেই বেড়েছে আত্মহত্যা। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা। খোদ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে উঠে এসেছে এমন চিত্র। দেখা গেছে, শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সী এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা।

ফেসবুকে আপত্তিকর ও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু ছবি ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ও লজ্জায় বিষপানে আত্মহত্যা করে মাদারীপুরের শিবচরের স্কুলছাত্রী লিপি আক্তার (১৭)। এলাকাবাসী ও লিপির পারিবারিক সূত্র বলছেন, শিবচর উপজেলার কাদিরপুর গ্রামের যুবক রনি বেপারীর সঙ্গে একই উপজেলার বালাকান্দি গ্রামের দুবাইপ্রবাসীর মেয়ে লিপির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছেলেপক্ষের বিয়ের প্রস্তাব মেয়েপক্ষ প্রত্যাখ্যান করে। এর পর থেকেই বখাটে যুবক রনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মেয়েটির কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি আপলোড করে। মেয়েটির বেশ কিছু ছবি ভাইরাল হয়। এতে ক্ষোভে ও লজ্জায় ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মেয়েটি বিষপান করে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে প্রথমে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ফরিদপুর এবং পরে ঢাকা নেওয়ার পথে গতকাল সকালে তার মৃত্যু হয়।            

আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করেন এমন অনেক মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মোহিত কামাল বলেন, ‘মহামারী করোনায় মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। তায় বিষন্নতায় ভুগছে। নানা রোগে মারা গেলেও মানুষ মনে করেছে করোনায় মৃত্যু হয়েছে। আমাদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। জীবনের অবমূল্যায়ন, চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়া, সন্তান স্কুলে না যাওয়ার কারণে মানুষ হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মানুষ বুদ্ধি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিষন্নতার চরম পরিণতি হচ্ছে আত্মহত্যা। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতাও কমে আসবে। সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, পরকীয়া সমস্যা, যৌতুক এসব কারণে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে পরিকল্পনা করেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।’

পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে চলমান মহামারীর মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সে সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর চলমান এক জরিপে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের পারসেপশন ছিল যে কভিডের সময় কভিডেই বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, অন্যান্য রোগে কম মারা যাচ্ছে। কিন্তু পরে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আগের অর্থবছরের ১০ মাস এবং এ অর্থবছরের ১০ মাসের তথ্য নিয়ে এ পর্যালোচনা করা হয়েছে।’

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) সূত্র বলছেন, মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ১ হাজার ৫৮ জন মানুষ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই নয় মাসে এ সংখ্যা ছিল ৯৪০। অর্থাৎ করোনার নয় মাসে আত্মহত্যার হার ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আফসানা আফরিন সুমি (১৯) গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন। খুলনার খানজাহান আলী থানার ফুলবাড়িগেট মীরেরডাঙ্গা এলাকার ইউনুস মোল্লার মেয়ে সুমি। শিক্ষার্থীর বাবা লিখিত অভিযোগে বলেছেন, ‘সুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করত না। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া ও কথাকাটাকাটির জের ধরে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে।’ তবে সুমির সহপাঠীরা জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সুমির। কিছু দিন আগে সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। এ নিয়ে সুমি বেশ হতাশায় ভুগছিলেন। তাদের ধারণা, প্রেমের সম্পর্কের জেরেই সুমি আত্মহত্যা করেছেন। সুমির ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ স্টোরি ঘেঁটে দেখা যায়, ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়াকে কেন্দ্র করে তিনি বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছিলেন। পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৫৪ হাজার ৩৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। এসব আত্মহত্যা হয়েছে ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষপানে। এর বাইরে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, লাফিয়ে পড়া, রেললাইনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো ঘটনাও ছিল।

২০১৪ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে। এর বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী। এদিকে গতকাল ঠাকুরগাঁওয়ে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা দিতে বিলম্ব হওয়ায় অভিমানে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে স্কুলছাত্রী জবা রানী (১৬)। সে সদর উপজেলার ৬ নম্বর আউলিয়াপুর ইউনিয়নের কচুবাড়ী বানিয়াপাড়া গ্রামের হরকুমার রায়ের একমাত্র মেয়ে। জবা কচুবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জবা খুব মেধাবী ছাত্রী। কয়েক দিন আগে বাবার কাছে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য টাকা চায়। বাবা টাকা দিতে বিলম্ব করায় পরিবারের সঙ্গে অভিমানে সে আত্মহত্যা করে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে মানুষ ছোটবেলা থেকেই একটু বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ছে। অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়াও আত্মহত্যার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে শিশুরা বেশি সময় ব্যয় করছে। এ কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে তাদের চোখ, মাথা ও কানের মতো পঞ্চেন্দ্রিয়ের ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়ছে। এতে তারা সংবেদনশীল হতে বাধ্য।’

তিনি বলেন, মূলত প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতে না পারা মানুষকে বিষন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। একজন মানুষের জীবনে একের পর এক এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাকে চরম মাত্রায় হতাশ করে তোলে। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে এটাই হয়ে আসছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে সমাজ নানা জটিল বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধসমূহ ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার।’ তারা বলেন, ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে আরও বেশি শক্তিশালী করা প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। মেয়েদের জন্য তৈরি করতে হবে সামাজিক সুরক্ষার বলয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় মেয়েরা শুধু মেয়ে হওয়ার কারণেই নানা সংকটের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরি করে। সেই সঙ্গে নারীবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. সালাউদ্দীন কাওসার বলেন, ‘কেউ কোনো সমস্যায় আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসা না হলে বিষন্নতা ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভুগতে থাকে মানসিক রোগে। আর এর শেষ পরিণতি গিয়ে ঠেকে আত্মহত্যায়।’

 

অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা

 

আর্থিক চাপ ও খাপ খাওয়াতে না পারা অন্যতম কারণ

 

মানসিক অসুখ বড় কারণ

 

তরুণদের মধ্যে প্রবণতা বেশি

 

সর্বশেষ খবর