সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষার বৈচিত্র্য ধরে রাখতে হবে

-প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভাষার বৈচিত্র্য ধরে রাখার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিভিন্ন দেশে ভাষা হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে হবে। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে গতকাল আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠান ও পদক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সরাসরি জড়িত ছিলেন সেই সত্য চেপে রাখা যায়নি। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ বিষয় প্রমাণিত হয়েছে। তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল ভাষা আন্দোলন শুরু করার কারণেই। সে কারণে তিনি বারবার গ্রেফতার হন। দীর্ঘ কারাবাস তাঁকে করতে হয়। শেখ হাসিনা বলেন, ভাষা আন্দোলন যে তিনি (বঙ্গবন্ধু) শুরু করেছিলেন  এবং সেখানে তাঁর যে অবদান রয়েছে এটা আমাদের অনেক জ্ঞানী-গুণী ও বুদ্ধিজীবীও মানতে রাজি হতেন না। তাঁদের কথা হলো- ‘শেখ মুজিব তো জেলে ছিল, সে আবার ভাষা আন্দোলন করল কীভাবে?’। জেলে তিনি গিয়েছিলেন কেন? তাঁকে তো গ্রেফতার করা হয়েছিল এই ভাষা আন্দোলনটা শুরু করলেন এবং ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করলেন, সে কারণে তিনি বারবার গ্রেফতার হন। এটা কিন্তু সম্পূর্ণ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লেখা ডকুমেন্ট, রিপোর্ট। সেখান থেকে ইতিহাসের অনেক সত্য বেরিয়ে এসেছে।

সত্যকে কেউ মুছে ফেলতে পারে না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতার অবদানের কথা আমি বারবার বক্তব্যে বলেছি। যখন সবাই অস্বীকার করত, তখন আমি এটা বেশি করেই বলতাম। আজ মনে হচ্ছে আমার আর বলার প্রয়োজন নেই। এখন সবই জানতে পারবেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা রিপোর্ট থেকে এ সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারবেন।

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। জাতির পিতা ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করি। স্বাধীন রাষ্ট্র পাই। স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাই। আমরা যে চেতনা নিয়ে কাজ করছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই চেতনা মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রক্তের বিনিময়ে আমরা যে নিজের ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, আজ তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছি। আজ কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশও এ দিবসটি পালন করছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের অন্য ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে মাতৃভাষাও শিখতে হবে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে সরকারপ্রধান বলেন, ভাষার অধিকার রক্ষা করা, ভাষাকে সম্মান দেওয়া এবং হারিয়ে যাওয়া ভাষাগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য। আমরা এই ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার কাজ শুরু করি। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এর কাজ বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আবারও ক্ষমতায় এসে শুরু করি। এর কাজ আমরা অব্যাহত রেখেছি। আমাদের লক্ষ্য হলো সারা বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া এবং চলমান ভাষাগুলোর নমুনা এখানে সংরক্ষণ করা। গবেষণা করা, ভাষার ইতিহাস সংরক্ষণ করা। এজন্য ভাষা জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। কোনো ভাষা যাতে হারিয়ে না যায়, তার জন্য এই ব্যবস্থাটা আমরা নিয়েছি।

ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ক্যাটাগরি-২ ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী এ সময় ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, মাতৃভাষা মানুষের আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। ভাষা ও সংস্কৃতির দ্বারা মানব ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবহমান থাকে। পৃথিবীর ভাষাবৈচিত্র্য সংরক্ষণ, চর্চা ও বিকাশ এবং বহুভাষিক সংস্কৃতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উদযাপনের প্রকৃত তাৎপর্য। আমরা চাই অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই চেতনা সবার মধ্যে সঞ্চারিত হোক। দূরীভূত হোক সব বিভেদ। সবার মধ্যে জেগে উঠুক স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। বিশ্বের সব মাতৃভাষা স্বমহিমায় বিরাজিত থাকুক ও বিকশিত হোক।’ জাতীয় পর্যায়ে মাতৃভাষা পদক পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক ভাষাবিজ্ঞানী ও নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম ও বেসরকারি সংগঠন খাগড়াছড়ির জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ পদক পান উজবেকিস্তানের গবেষক ইসমাইলভ গুলম মিরজায়েভিচ। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কাজ করা বলিভিয়ার অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগ অ্যাকটিভিজমো লেংকুয়াসকে বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি পদক তুলে দেন। শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী।

নিজের শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের হাতে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক’ তুলে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রফিকুল ইসলাম সাহেবের হাতে পদক তুলে দেওয়া এটা যে আমার জন্য কত সম্মানের এবং গৌরবের, কিন্তু আমি নিজের হাতে দিতে পারলাম না। স্যার আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। 

তিনি আরও বলেন, আমি এই করোনাভাইরাসের কারণে প্রধানমন্ত্রী হলেও সব স্বাধীনতা থাকে না। অনেকটা বন্দী জীবনযাপন করতে হয়, সে রকমই আছি। কারণ আমি এক জায়গায় যেতে গেলে আমার সঙ্গে বহু লোক। নিরাপত্তার লোক, অমুক লোক-তমুক লোক, প্রায় হাজারখানেক লোককে রাস্তায় দাঁড় করায়, নানাভাবে তাদের কাজে লাগায়। তাদের কথা চিন্তা করেই কিন্তু আমি আসতে পারিনি। তবু আমি অভিনন্দন জানাই আপনাকে। একই সঙ্গে অন্য যারা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের প্রতিও আন্তরিক অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক হিসেবেই এটা সবসময় থাকা ভালো। যারা এই পুরস্কারটা পেলেন মনে করি-এটাও একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো যে, আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে গুণীজনের সম্মান এবং ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে পারলাম।

সর্বশেষ খবর