বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বাহারি বিজ্ঞাপনের আড়ালে প্রতারণা

ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য, বারবার অভিযানেও বদলাচ্ছে না পরিস্থিতি, দামে আকাশচুম্বী হেরফের

সাঈদুর রহমান রিমন ও রুহুল আমিন রাসেল

বাহারি বিজ্ঞাপনের আড়ালে প্রতারণা

রাজধানীর একটি সুপারশপ -জয়ীতা রায়

চেইন সুপার শপগুলোর বাহারি বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ হয়ে কেনাকাটা করে পকেট কাটা যাচ্ছে ক্রেতাদের। বেশির ভাগ পণ্যেই ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করা হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়, এগুলো বাজারমূল্যের চেয়েও কম দাম। এখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। এর বাইরে শত শত পণ্যের গলা কাটা দাম রাখা হয়।

চটকদার বিজ্ঞাপন আর অভিনব বিক্রয় কৌশলে অনেক ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য কিনতে বাধ্য করা হয় ক্রেতাদের। নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রির অভিযোগ বেশির ভাগ সুপারশপের বিরুদ্ধে। সেগুলোকে বহুবার জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু অনিয়ম বন্ধ হয়নি।

কিছু দিন আগে খাদ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজধানীর শান্তিনগরে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য রাখায় জরিমানা করা হয় কয়েকটি সুপারশপকে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আয়োজিত এ অভিযানে পচা মাছ, মাংস এবং মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য রাখার অপরাধে একটি সুপারশপের শান্তিনগর এলাকার ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। অন্য একটি সুপারশপে মেয়াদোত্তীর্ণ পাউরুটি ও অন্যান্য খাবার রাখার দায়ে ম্যানেজারকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। একই অভিযোগে অন্য এক সুপারশপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়। পচা মাছ, মাংস বিক্রি, পণ্যের অতিরিক্ত দামসহ মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি পণ্য বিক্রির অভিযোগ             রয়েছে সুপারশপগুলোর বিরুদ্ধে। ধানমন্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী আমিনউদ্দিন বলেন, ‘সুপারশপগুলোয় বহু অভিযান চলেছে। কিন্তু তারা কোনো কিছুকেই গা করে না।’ তার মতে যেসব সুপারশপের বিরুদ্ধে তিনবারের বেশি অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুপারশপগুলোয় বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যের সরবরাহ আসে নির্দিষ্ট কিছু কোল্ড স্টোরেজ থেকে। সেসব কোল্ড স্টোরেজে রাখা পণ্যসামগ্রীর অবস্থা খুবই শোচনীয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এ ধরনের কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ থেকে এক বছর আগের প্রায় ১ হাজার মন মাংস ও পাঁচ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ প্যাকেটজাত খাবার জব্দ করা হয়। ছিল পচা মাছের ছড়াছড়ি। মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার রাখার দায়ে তিনটি কোল্ড স্টোরেজকে ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় মালিকসহ ১৮ জনকে। কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজারের রুমে পাওয়া যায় সুপারশপগুলোয় মাংস পাঠানোর রসিদও। দেশে প্রথম সুপারশপ চালু হয় ২০০১ সালে। গত দেড় দশকে এর চাহিদাও বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে দেশে ৩০টির মতো কোম্পানি আছে, যারা সারা দেশে ২ শতাধিক সুপারশপ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ সুপার মার্কেটস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসওএ)-এর হিসাব অনুযায়ী সুপার মার্কেট খাতে বর্তমানে বার্ষিক টার্নওভার দেড় হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় একটা খাত হওয়া সত্ত্বেও ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে সুপারশপ। চাকচিক্য বিজ্ঞাপন, থরে থরে সাজানো রংবেরঙের মোড়কের আড়ালে সুপারশপের পরতে পরতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। তাদের বিজ্ঞাপনের ফাঁদে আটকে ক্রেতাদের পকেট কাটা গেলেও ফুলে ফেঁপে উঠেছে সুপারশপের ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানভেদে একই পণ্যের মূল্যে আকাশচুম্বী পার্থক্য। শুধু পণ্যসামগ্রীতেই গ্রাহকদের নানাভাবে ঠকিয়ে প্রতারণার ইতি টানা হচ্ছে না। সুপারশপগুলোয় ডিজিটাল হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রেও গ্রাহকদের বেশি বিল ধরিয়ে দেওয়ার ফাঁদ পাতা রয়েছে।

শাহেদ আলম নামে এক বেসরকারি চাকুরে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, তিনি সুপারশপগুলোর নিয়মিত গ্রাহক। কিন্তু তার সে বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরিয়েছে একটি সুপারশপ। তিনি বলেন, ‘মাছ-মাংস, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ক্যাশবক্সে গিয়ে বিল পরিশোধের জন্য যথারীতি দাঁড়ালাম। একটা কম্পিউটার প্রিন্টেড বিল দিল আমাকে। প্রতিটি জিনিসের গায়ে লেখা দাম অনুযায়ী যেখানে আমার বিল আসার কথা ৫ হাজার টাকা, সেখানে আমাকে বিল ধরিয়ে দেওয়া হলো ৮ হাজার টাকার। আমি সব পণ্যের ট্যাগ আবার চেক করতে বললাম। দেখা গেল ৫ হাজার টাকার একটু বেশি বিল এসেছে। তাদের প্রশ্ন করলাম তাহলে এত টাকা বিল কীভাবে এলো? তারা দুঃখ প্রকাশ করে জানালেন এটা কম্পিউটার সফ্টওয়্যারের ত্রুটির কারণে ঘটেছে।’

এ প্রসঙ্গে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো ক্রেতাই সুপারশপে কম দামের নামে প্রতারণা প্রত্যাশা করেন না। এখানে কেউ প্রতারিত হলে ভোক্তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে বিষয়টি ভোক্তা অধিদফতরকে জানানোর। সুপারশপে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রি হলে তা মোকাবিলায় আইনি ব্যবস্থা দরকার। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশন, র‌্যাব ও ভোক্তা অধিদফতরের অধিক নজরদারি দেখতে চাই।’ প্রতারণার বিরুদ্ধে ভোক্তাদেরও সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর সাবেক এই চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে সুপারশপগুলো কম দামে পণ্য বিক্রি করছে না। বাস্তবে সুপারশপগুলো চাতুর্যপূর্ণ প্রতারণা করছে। কারণ তারা একটি পণ্য কম দামে বিক্রি দেখিয়ে অন্য পণ্যসমূহ বেশি দামে বিক্রি করছে। আর একজন ক্রেতা একটি মাত্র পণ্য কিনতে সুপারশপে যাচ্ছেন না। তারা একাধিক পণ্য কিনছেন। আর এভাবে সুপারশপগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে ভয়াবহ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।’ এ প্রতারণা থেকে রেহাই পেতে অংশীজনদের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই)-এর সাবেক এই সহসভাপতি। তবে সুপারশপ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সুপারশপগুলোর ব্যবসা ভালো না। কিন্তু খরচ অনেক বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন বেহাল।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ হারে সুপারশপের বাজার বাড়ছে।

জানা যায়, সারা দেশে অভিজাত সুপারশপগুলোয় কম দামে পণ্য বিক্রির নামে প্রতারণার একাধিক তথ্য রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছেও। সরকারি একাধিক সংস্থার অভিযানে দাম বেশি রাখা, পচা-বাসি খাবার বিক্রি, ভেজাল খাবারসহ নানা ধরনের অসংগতি উঠে আসছে বড় বড় সুপারশপে। অথচ এসব অভিজাত শপের প্রতি ক্রেতার আস্থা ও নির্ভরতা ছিল। এ সরল নির্ভরতা পুঁজি করে ক্রেতাসাধারণের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করা হচ্ছে, যা নিরাপদ খাদ্য আইনের লঙ্ঘন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন ক্রেতারা। ভোক্তা অধিকার, নিরাপদ খাদ্য অধিদফতরসহ বেশ কয়েকটি সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আছে। ক্রেতাদের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু সংস্থাগুলোর ব্যর্থতায় প্রতিনিয়ত লঙ্ঘন হচ্ছে ক্রেতার অধিকার। শুধু রমজান এলে সক্রিয় হয় সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। তাদের অভিযানে দাম বেশি রাখা, পচা-বাসি খাবার বিক্রি, ভেজাল খাবারসহ নানা ধরনের অসংগতি উঠে আসে। বিভিন্ন সময় র‌্যাবের অভিযানে অভিজাত সুপারশপে বিপুল পরিমাণ পচা মাছ-মাংস পাওয়া যায়। এসব অভিযানে মেয়াদোত্তীর্ণ দই-দুধ, পচা মাছ-মাংস বিক্রির দায়ে সুপারশপগুলোকে জরিমানাও করা হয়।

এসব সুপারশপের ক্রেতারা আলাপকালে জানিয়েছেন, খাদ্য উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, মাছ ও ফলে ফরমালিন, অন্যান্য প্যাকেটজাত খাবারে ভেজাল ও ক্ষতিকারক রং ব্যবহার বন্ধে নিরাপদ খাদ্য আইন রয়েছে। কিন্তু আইনটি শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। এ আইন প্রয়োগ করা হলে এত অপরাধ হতো না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। অংশীজনদের মতে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি সবার অধিকার। প্রথম তো জনসাধারণকে সচেতন হতে হবে। খাদ্য গ্রহণে অনেক সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি বিক্রেতারও নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

সর্বশেষ খবর